জনবহুল দেশে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন। তবে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে পরিবেশের দ্রুত ও ব্যাপক অবনতি কিছু মাত্রায় রোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশ জনবহুল হলেও শিল্পায়নের দিক থেকে আমরা পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় এখনো পিছিয়ে আছি। সে কারণে শিল্পক্ষেত্রের বর্জ্য থেকে পরিবেশদূষণের মাত্রা আমাদের দেশে কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শিল্পের কারণে আমাদের পরিবেশদূষণের মাত্রা কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষায় পারদর্শিতাবিষয়ক সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে অবস্থান ১৬২তম। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আমরা সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সারিতে রয়ে গেছি। এটি বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয়, কারণ আমাদের দেশের আয়তন কম, সে তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। এ রকম উচ্চমাত্রার জনঘনত্বপূর্ণ দেশ প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় পারদর্শী না হলে দেশবাসীর স্বাস্থ্যসহ সামগ্রিক জীবনমান ক্রমেই হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এমন নয় যে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে আমাদের সচেতনতার ঘাটতি আছে। পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আমরা আইন প্রণয়ন করেছি অন্তত দুই যুগ আগে। ১৯৯৫ সালে গৃহীত সেই ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন’ যথেষ্ট ভালো একটি আইন। পরিবেশদূষণ-সংক্রান্ত অপরাধের বিচার করার জন্য এ দেশে তিনটি পৃথক আদালতও রয়েছে। কিন্তু এ আইনের পর্যাপ্ত প্রয়োগ হচ্ছে না বলে পরিবেশদূষণ-সংক্রান্ত অপরাধগুলো যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। যাঁদের কর্মকাণ্ডের ফলে পরিবেশের দূষণ ঘটছে, তাঁদের মধ্যে এটা অনুধাবনে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে যে তাঁদের ওই সব কর্মকাণ্ড পরিবেশ সুরক্ষা আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। কিংবা তাঁরা সেগুলোকে অপরাধ বলে গণ্য করলেও এ রকম ভেবে নিশ্চিন্ত থাকেন যে কিছু জরিমানা পরিশোধের মাধ্যমেই ওই সব অপরাধের শাস্তি এড়ানো সম্ভব।
গত শনিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের তিনটি পরিবেশ আদালতে এ মুহূর্তে মামলা রয়েছে মোট ৭ হাজার ২টি। এগুলোর মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে দায়ের করা মামলার সংখ্যা মাত্র ৩৮৮, যা মোট মামলার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। আদালতগুলো স্থাপন করা হয়েছে পরিবেশদূষণসংক্রান্ত অপরাধগুলোর বিচার করার উদ্দেশ্যে, অথচ সেগুলোয় এ-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাই সবচেয়ে কম। এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রণীত আইনের প্রয়োগ কত কম। শুধু তা-ই নয়, পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান প্রবণতা হলো ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা করে জরিমানা আদায় করা। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা করেছে ৮ হাজার ৭৫৬টি, জরিমানা করেছে প্রায় ৫৩ কোটি টাকা, এর মধ্যে ৪৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে।
পরিবেশদূষণসংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে স্থায়ী আদালতে মামলা করার পরিবর্তে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জরিমানা আদায় করার এ চর্চার ফলে পরিবেশদূষণকারীদের মধ্যে এ-সংক্রান্ত অপরাধগুলোকে লঘু দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত যে পরিমাণ জরিমানা ঘোষণা করেন, অপরাধীরা আপিলের মাধ্যমে তার একটা বড় অংশের ছাড় পেয়ে যায়। ফলে তারা ধরেই নেয় যে পরিবেশদূষণ করা এমন কোনো গুরুতর অপরাধ নয়, যার জন্য কারাভোগ করতে হবে, বরং কিছু অর্থদণ্ড দিয়েই ছাড় পাওয়া সম্ভব। ফলে তাদের পরিবেশদূষণকারী কর্মকাণ্ড চলতেই থাকে।
কিন্তু এভাবে আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। পরিবেশদূষণ-সংক্রান্ত অপরাধগুলোর যথাযথ বিচারের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের অ্যাডহক ব্যবস্থার পরিবর্তে স্থায়ী আদালতে মামলা বাড়াতে হবে; অপরাধীদের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড, উভয় ধরনের দণ্ড এবং পরিবেশদূষণকারী স্থাপনা-প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।