যে সম্পত্তির ওপর দখলকারী ব্যক্তির স্বত্বাধিকার দাবি সর্বজনমহলের বিবেচনায় স্পষ্টতই অন্যায্য ও অসংগত, সেই দখলকারীর প্রতি বিদ্রূপাত্মক শ্লেষ বর্ষণে ‘বাপের সম্পত্তি’ শব্দবন্ধটির স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহারের চল বহু প্রাচীন। অর্থাৎ গায়ের জোরে কেউ অন্যের সম্পদকে ‘পৈতৃক সম্পত্তি’ জ্ঞানে কুক্ষিগত করলে ‘এটি কি আপনার বাপের সম্পত্তি?’ গোছের প্রশ্ন তুলে সেই মালিকানা দাবিকে প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়। কিন্তু দখলকারী যদি ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও প্রশাসনঘনিষ্ঠ প্রবল ক্ষমতাধর ব্যক্তি হন এবং দখলকৃত সম্পত্তি যদি সরকারি তথা জনগণের হয়, তাহলে সাধারণত কেউ তাঁকে সেই বিব্রতকর প্রশ্নটি করে নিজে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার ঝুঁকি নেন না। সে ক্ষেত্রে উল্টো দখলকারী ব্যক্তিই জনগণের মালিকানা দাবিকে নির্বিকার দম্ভে ছুড়ে ফেলে দখল করা সম্পত্তিকে ‘পৈতৃক সম্পত্তি’ বলে নিরঙ্কুশ মালিকানা দাবি করে বসেন।
ক্ষমতাধরদের জনসম্পত্তি আত্তীকরণের এই প্রাচীন ঐতিহ্য নতুন মাত্রায় ধরা দিয়েছে মুন্সিগঞ্জে। সেখানে শত বছরের পুরোনো রজতরেখা নদীর উৎসমুখ বন্ধ করে নদীর একটি বড় অংশকে আক্ষরিক অর্থে পৈতৃক সম্পত্তি বলে দাবি করেছেন সেখানকার কয়েকজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সেই ‘পৈতৃক সম্পত্তি’ থেকে তাঁরা কোটি টাকার মাটি বিক্রি করছেন এবং যথারীতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘দেখছি, দেখব’ করা হচ্ছে।
প্রথম আলোর সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, সদর উপজেলার শিলই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসেম, তাঁর ছোট ভাই ইসমাঈল ব্যাপারী ও তাঁর চাচাতো ভাই শাহাদাৎ ব্যাপারীর নেতৃত্বে একটি চক্র দীঘিরপাড় এলাকায় রজতরেখা নদীর উৎসমুখ মাটি ফেলে বন্ধ করে সেখানে রীতিমতো বাজার বসিয়ে দোকানপাট তুলেছেন। সেই দোকান থেকে তাঁরা ভাড়া তুলছেন। অন্যদিকে বাঁধ দেওয়ায় নদী শুকিয়ে গেছে। এখন নদীগর্ভের মাটি বিক্রি করছেন তাঁরা।
পদ্মা থেকে উৎপত্তি হওয়া রজতরেখা নদীটি দীঘিরপাড়, বাগেশ্বর, সাতানীখিল, কাটাখালী হয়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে গিয়ে ধলেশ্বরীতে মিশেছে। ধলেশ্বরী প্রান্ত দিয়ে এখন কিছুটা পানি ঢুকতে পারলেও চেয়ারম্যান মহোদয় তাঁর ‘পৈতৃক সম্পত্তিতে’ বালু ফেলায় নদীটির পদ্মার প্রান্ত সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ এই নদীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এ নিয়ে যতবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, ততবারই ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে শেষ পর্যন্ত আশ্বাসঘাতকতা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, জেলা প্রশাসক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে সময়ক্ষেপণ করা হলে তত দিনে ‘প্রায় নিহত’ নদীর বুক খুবলে সব মাটি নিয়ে যাবে এই চক্র।
নদী ও খাল রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। এ জন্য নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালী—যে-ই হোক না কেন, যারা অবৈধভাবে নদী দখল করবে, তাদের উচ্ছেদ করা হবে বলেও ঘোষণা এসেছে। এ অবস্থায় অভিযুক্তদের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
মনে রাখা দরকার, নদী জনগণের সম্পত্তি। সেই সম্পত্তিকে কারও ‘বাপের সম্পত্তি’ বানাতে দেওয়ার অধিকার রাষ্ট্র কাউকেই দেয়নি।