দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দন্ত থাকা না থাকার বিতর্কটি অনেক পুরোনো। প্রতিষ্ঠানটির একজন সাবেক চেয়ারম্যান নিজেই দুদককে নখদন্তহীন বাঘ বলে অভিহিত করেছিলেন। রোববার সুইস ব্যাংকসহ বিদেশি ব্যাংকে জমা টাকা ফিরিয়ে আনতে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের শুনানির সময় বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চও সেই পুরোনো কথাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন। তাঁরা বলেছেন, দুদককে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দন্তহীন বাঘের মতো আচরণ বা দন্তহীন বাঘ হলে চলবে না।
এর মাধ্যমে দেশে যে ভয়াবহ দুর্নীতি চলছে, তা প্রতিরোধের তাগিদ দিয়ে আদালত বলেছেন, দুর্নীতি রোধে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট আইনটি সংস্কার করা উচিত, যাতে করদাতারা দেশে ও বিদেশে তাঁদের সম্পত্তির পরিমাণ প্রকাশ করতে পারেন। দুদক ২০১৯ সালের যে প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছে, তাতে দুর্নীতির এ ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পায়নি। দুর্নীতি বন্ধে দুদকের দেওয়া সুপারিশেও আইন সংস্কারের কথা বলা হয়নি। তারা দুর্নীতি বন্ধে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ ও পরীক্ষায় পাসের নম্বর ৩৩ থেকে ৫০ করার সুপারিশ করেছে। তাদের এ সুপারিশের গুরুত্ব অস্বীকার করছি না। কিন্তু পুলিশ বিভাগের মাঠপর্যায়ের নিয়োগ বিধি বদলালেই কি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাবে?
প্রতিটি সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর ঘোষণা দিলেও সব সময় আাইন নিজস্ব গতিতে চলে না। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আনা মামলা বছরের পর বছর অনিষ্পন্ন থাকে। আর বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নামে আনা মামলার বিচার দ্রুত হয়। এ কারণে দুর্নীতিবাজেরা রাতারাতি ভোল পাল্টে ক্ষমতাসীনদের দলে ভিড়ে যায়। আবার আইনগত ত্রুটির কারণেও অনেক দুর্নীতিবাজ পার পেয়ে যান।
আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ওপর জোর দিয়েছেন এবং প্রয়োজনে আইন সংস্কার করতে বলেছেন। কিন্তু দুদকের প্রস্তাবে আইন সংস্কারের কোনো কথা নেই। যখন দেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, তখনো দুদক চেয়ারম্যান দুর্নীতি বাড়ার কথা স্বীকার করতে চান না। টিআইয়ের দুর্নীতি ধারণা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম স্থানে থাকা কোনোভাবে স্বস্তিদায়ক নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আফগানিস্তানই আমাদের নিচে আছে। বাকি ছয়টি দেশই ওপরে। এ পরিসংখ্যান দুদককে বিব্রত না করলেও দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা বিব্রত বোধ করি।
প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন কোনো পদক্ষেপ এখনো নিতে পারেনি, যাতে মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়। এর কর্মকর্তাদের ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারণে অনেক নিরপরাধ মানুষ শাস্তিভোগ করেছেন। আদালত যথার্থই বলেছেন বড় দুর্নীতিবাজদের ছাড় দিয়ে ছোট দুর্নীতিবাজকে ধরলে হবে না। সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
মনে রাখতে হবে, দুদক সরকারের অধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের কাছে স্বাধীন আচরণই প্রত্যাশিত। দুদক সব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলে দেশ থেকে দুর্নীতি পুরোপুরি রহিত না হলেও এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব নয়।