একই দিনের পত্রিকায় পাশাপাশি দুটি খবর কাকতালীয় কোনো ঘটনা নয়, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। প্রথম খবরটি মানব ও মুদ্রা পাচারের দায়ে কুয়েতের আদালতে বাংলাদেশের সাংসদ শহিদ ইসলাম ওরফে পাপলুর চার বছর কারাদণ্ড ও বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৩ কোটি টাকা জরিমানা। দ্বিতীয় খবর হলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআইয়ের প্রতিবেদনে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনতি।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে যে দুর্নীতি কমেনি, টিআইয়ের প্রতিবেদন ও বিদেশি আদালতে একজন সাংসদের দণ্ডিত হওয়া তার দুটি প্রমাণ।
টিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। গত বছর ছিল ১৪তম। দুই ধাপ নিচে নেমে এলেও সূচক অপরিবর্তিত, ১০০–এর মধ্যে ২৬। গত বছর বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে উজবেকিস্তান ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র সূচকে এগিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ক্রম দুই ধাপ পেছনে চলে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে থেকে দ্বিতীয়। প্রথম আফগানিস্তান। আর দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান, ওপরের দিক থেকে ২৪তম। এরপর মালদ্বীপ ৭৫তম, ভারত ৮৬তম, শ্রীলঙ্কা ৯৪তম, পাকিস্তান ১২৪তম এবং বাংলাদেশ ১৪৬তম।
এ তথ্য আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে নীতিনির্ধারকদের এত বক্তৃতা–বিবৃতিই কি ফাঁকা আওয়াজ? তাঁরা বলছেন , দুর্নীতির বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সরকার যেটুকু ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেটুকুই গণমাধ্যমে আসছে এবং দেশবাসী জানতে পারছে। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেই বড় ধরনের ফাঁকফোকর আছে। ফলে দু–চারজন দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে কোনো লাভ হবে না। পদ্ধতিগতভাবে যে দুর্নীতি হচ্ছে, সেখানে হাত দিতে হবে। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের তালিকাসংক্রান্ত একটি মামলায় অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে, আদালত দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককেও কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। এসব নির্দেশনা কতটা প্রতিপালন হয়, তার ওপরই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে অনেক রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় আনা হয়। তাঁদের অনেকে এখন জেলে। পি কে হালদার, জি কে শামীম প্রমুখ দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এসব ইতিবাচক পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে যে কথাটি বলা আবশ্যক তা হলো বাছাই করা অভিযান নয়, দলমত ও অবস্থান–নির্বিশেষে সব দুর্নীতিবাজকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতির ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করতে হবে।
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হয়েছে, তাকে স্বাগত জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সরকারের ঘোষণা ও বাস্তবায়নের মধ্যে যে ফারাক আছে, তা দূর করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। টিআইয়ের সূচকে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ১ নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল। সেখান থেকে কিঞ্চিৎ এগিয়ে এখনো ১২–১৪–তে মার্কটাইম করছি। এভাবে চললে আগামী ১০০ বছরেও বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের গ্লানি থেকে মুক্ত হতে পারবে না। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাগত সক্ষমতাও জরুরি।