টিলা কেটে কলাবাগান

সম্পাদকীয়

পঞ্চগড়, সিলেট আর পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় বেড়াতে গিয়ে ওই পারের বড় পাহাড়গুলো দেখে আফসোস করেনি, এমন মানুষ কমই আছে। ‘ইংরেজরা বড় একচোখা, বড় পাহাড়গুলো সব ওদের দিয়েছে, আর আমাদের ভাগে পড়েছে সব ছোট ছোট পাহাড়,’ এই বলে তারা হাপিত্যেশ করে। সিলেটের গোয়াইনঘাটের দক্ষিণ রামনগর গ্রামের গোলাপ মিয়া মনে হয় এঁদের মতো পাহাড়প্রেমী নন। তাঁর বোধ হয় সমতলই পছন্দ। নইলে নিজের মালিকানাধীন সুন্দর একটা টিলা কেটে তিনি কেন সমতল করবেন? রামনগরে তাঁর নিজের ২১ বিঘা জমির মধ্যে ৭ বিঘা জায়গাজুড়ে ওই টিলা ছিল। শ্রমিক লাগিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ২০ ফুট উঁচু সেই টিলা নাই করে দিয়েছেন তিনি। কলা চাষ করতে নাকি কাজটা করেছেন তিনি। শুনলে তো মনে হয়, ভালো কাজ করেছেন গোলাপ মিয়া। জায়গাটা অনাবাদি পড়ে ছিল, কোনো কাজেই আসছিল না, সেখানে তিনি কলা চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। খারাপটা কী? ঠিক যে ধরনের যুক্তি দেখিয়ে দেশজুড়েই আমরা খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট করে আবাসন গড়ছি, বন কেটে বসত গড়ছি, আবাদের জমি বের করছি। অবাধ পানির প্রবাহ বন্ধ করে বাঁধ দিয়ে মাছের চাষ করছি।

তবে টিলা কাটা-কাণ্ডে এই যুক্তিও খাটে না। কারণ, কলাবাগান করতে টিলা কাটার দরকার পড়ে না। টিলা অক্ষত রেখেই কলাবাগান করা যেত, যেমনটা পাহাড়ি জেলাগুলোতে হামেশাই করা হয়। তার এই টিলা লোপাটের আদত কারণ নাকি জায়গাটাকে বসতভিটায় রূপান্তরিত করা। টিলাজমির চেয়ে ভিটামাটির দাম বেশি। এভাবেই প্রতিনিয়ত বেশি লাভের লোভে নিসর্গ পরিবেশ আর প্রতিবেশকে আমরা তছনছ করছি। কলকারখানার দূষিত পানি সরাসরি নদীতে ঢেলে দিচ্ছি, বিষাক্ত বর্জ্য মাটিতে ছেড়ে দিচ্ছি, দূষিত বাতাস আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছি।

সারা দুনিয়াতেই মুনাফালোভী মানুষ আছে। এদের ঠেকানোর জন্য আছে আইন আর সেই আইন প্রয়োগ করার জন্য আছে পর্যাপ্ত জনবলসমৃদ্ধ শক্তিশালী সংস্থা। বাইরে পরিবেশ আইন ভঙ্গ করলে কোটি কোটি ডলার পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। ফলে যতটা না পরিবেশকে ভালোবেসে, তার চেয়ে বেশি জরিমানার ভয়ে নিজেদের সংযত রাখে মুনাফালোভীরা। এখানেই আমরা অসহায়। আমাদেরও আইন আছে। এই যেমন গোলাপ মিয়া যে অন্যায়টা করেছেন, ১৯৯৫ সালের পরিবেশ আইনে তাঁর শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। কিন্তু গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের এই সহসভাপতি ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা কি নিতে পারবে প্রশাসন?