জ্ঞানসূচকে পিছিয়ে বাংলাদেশ

ব্রিটিশ দার্শনিক স্যার ফ্রান্সিস বেকন ষোড়শ শতকে বলেছিলেন, জ্ঞানই শক্তি। আমাদের রাষ্ট্রের যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা মুখে জ্ঞানচর্চার কথা বললেও রাষ্ট্রীয় নীতিতে তার প্রতিফলন ঘটছে সামান্যই। গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স-২০২০ অনুযায়ী, ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম এবং তালিকায় স্থান পাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে সবার শেষে।

জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশন যৌথভাবে বুধবার এ বৈশ্বিক জ্ঞানসূচক প্রকাশ করে। ২০১২ সালের তুলনায় বাংলাদেশ বিভিন্ন চলকে শূন্য দশমিক ৯ পয়েন্ট উন্নীত করে মোট ৩৫ দশমিক ৯ নম্বর পেলেও বৈশ্বিক গড় নম্বর ৪৬ দশমিক ৭-এর অনেক কম। ২০১২ সালেও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১২তম।

সাতটি সেক্টরের অধীনে ১৩৩টি চলক বিশ্লেষণ করে তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। প্রধান সাতটি সেক্টর হচ্ছে প্রাক্‌-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা, উন্নয়ন এবং উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সাধারণ সক্ষমতার পরিবেশ। দুই বছর আগে এশিয়া মহাদেশে উদ্ভাবন সূচকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল, আর শীর্ষে ছিল সিঙ্গাপুর। গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স অনুযায়ী, সবচেয়ে কম উদ্ভাবনী দেশের কাতারে আছে বাংলাদেশ, কাজাখস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তান।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ করার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন খাতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। অনেক অত্যাবশ্যক প্রযুক্তি আমাদের আয়ত্তের বাইরে আছে। তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশ বেশ ভালো করছে; কিন্তু এ খাতে টেকসই উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। অধিকাংশ যন্ত্রপাতি বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এ কারণে উন্নত দেশ দূরে থাক, মধ্যম মানের ২৪টি দেশের মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান ১৯তম।

সরকার শিক্ষার উচ্চ হার নিয়ে গর্ব করে। অথচ বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকের চলকগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষা খাতে অন্য দেশগুলোর তুলনায় খারাপ অবস্থানে বাংলাদেশ। কয়েক বছর আগে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাতে যা পড়ানো হচ্ছে, তার ব্যবহারিক মূল্য খুবই কম। অন্যদিকে যার ব্যবহারিক মূল্য আছে, সেই জ্ঞান আমরা শিক্ষার্থীদের দিতে পারছি না।

গ্লোবাল নলেজ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৪৪ দশমিক ৪ পয়েন্ট নিয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে (বিশ্বে ৭৫তম) আছে ভারত। ৪২ দশমিক ১ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় এবং বিশ্বে ৮৭তম অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। অন্যদিকে ৪০ দশমিক ৯, ৩৬ দশমিক ২ এবং ৩৫ দশমিক ৯ স্কোর নিয়ে যথাক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান। ৩৫ দশমিক ৯ স্কোর নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার শেষে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই দুঃখজনক ঘটনা।

অর্থনীতি ও মানবসম্পদের নানা সূচকে বাংলাদেশ ভালো করছে। আমাদের গড় আয় ও আয়ু দুটোই বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হলে এ উন্নয়ন টেকসই হবে না। অতএব সরকারের উচিত বেকার তৈরি করার শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে প্রযুক্তিনির্ভর ও যুগোপযোগী শিক্ষার দিকে নজর বাড়ানো।