‘গত বছর বন্যার কারণে আউশ ও আমনের চালের উৎপাদন কম হয়েছে। সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। সরকারি খাদ্যগুদামে ধান-চালের পর্যাপ্ত মজুত না থাকায় মিলমালিক ও পাইকারেরা সুযোগ নিয়েছেন।’ এ কথাগুলো বলেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। গত মঙ্গলবার ঢাকায় কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে চাল, আলু ও পেঁয়াজের প্রাপ্যতা: একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা’ শিরোনামের প্রতিবেদন উন্মোচন অনুষ্ঠানে দেওয়া তাঁর এ বক্তব্যে একটা সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা হলো এ দেশে চালকলের মালিক ও ধান-চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর ‘সুযোগ’ নিতে পারেন।
ব্যবসায়ীদের জন্য এ সুযোগ কখন ও কী পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়, তা–ও কৃষিমন্ত্রীর ওই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে: সরকারি গুদামে যখন চালের পর্যাপ্ত মজুত থাকে না, তখনই মিলমালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের সামনে চালের দাম বাড়ানোর মোক্ষম সুযোগ চলে আসে। সুতরাং সে রকম পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর গবেষকদের একটি দলের গবেষণার ভিত্তিতে প্রণীত প্রতিবেদনটিতে চালের মৌসুমি মূল্যবৃদ্ধি এড়ানোর কয়েকটি উপায় বাতলানো হয়েছে, যেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। সুপারিশগুলো এ রকম: ধান-চাল সংগ্রহের পদ্ধতির আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে চালকলমালিকদের দ্বারা তা চালে পরিণত করতে হবে। মোটা ও চিকন চালের জন্য সরকারকে পৃথক ন্যূনতম সহায়তা মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করা উচিত। সরকারি গুদামে সব সময় কমপক্ষে সাড়ে ১২ লাখ টন চাল মজুত থাকবে—এটা নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরি। এটা নিশ্চিত হলে মিলমালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সংঘবদ্ধভাবে দাম বাড়ানোর সুযোগ পাবে না। সরকারকে যথাসময়ে কার্যকরভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হবে; সে জন্য প্রতি মৌসুমে কমপক্ষে ২৫ লাখ টন চাল সংগ্রহ করতে হবে। ধানচাষিদের স্বার্থের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ধান-চালের সংগ্রহমূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করা দরকার, যাতে চাষিদের উৎপাদন খরচ বাদে কমপক্ষে ২০ শতাংশ লাভ থাকে।
এবার আমনের ভরা মৌসুমে চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি পেঁয়াজের দামও বেড়ে গিয়েছিল অস্বাভাবিক হারে। গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে দেশীয় অসাধু বাণিজ্য সিন্ডিকেটের বাজারে কারসাজি মূল্যবৃদ্ধির একটা কারণ। তারা এ কারসাজির সুযোগ পেয়েছিল ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে। সুপারিশ করা হয়েছে, পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে; আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে নিজেদের উৎপাদন বাড়ানো এবং যখন আমদানি অপরিহার্য হয়ে ওঠে, তখন একটি দেশের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দ্রুত একাধিক রপ্তানিকারক দেশের সন্ধান করা উচিত।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আলুর মূল্যবৃদ্ধির যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর প্রথমেই আছে ভবিষ্যতে আলুর দাম বাড়বে—এ আশায় আলুচাষি ও আলু ব্যবসায়ীদের আলু মজুত করে রাখা; বিশেষত আলুর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ব্যাপক মজুতদারি এবং কৃত্রিম সংকট তৈরি করা। আলুর বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্বারা, এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বেশ সীমিত। প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, আলুর বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া হিমাগারে আলু সংরক্ষণ ও তা বের করে আনার প্রক্রিয়াটির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি থাকা প্রয়োজন। আলুর উৎপাদন, চাহিদা, সরবরাহ ও মূল্যসংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করা এবং তা হালনাগাদ রাখার ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে।