ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় সোমবার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ঢুকে যে হামলা চালানো হলো, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও নিন্দনীয়। হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি নামের একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সহকারী হাইকমিশনের ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালালেও সেখানকার নিরাপত্তারক্ষীরা নিষ্ক্রিয় ছিলেন। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী বিদেশি মিশন ও সেখানকার কূটনীতিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব স্বাগতিক দেশের। বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটি সেই দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
এর আগে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সমর্থকেরা কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাসে সহিংস বিক্ষোভ করেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেন। ঘটনার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, ঘটনাপ্রবাহ দেখে প্রমাণিত হয়েছে যে হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত। এ ঘটনা কূটনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক ভিয়েনা সনদের লঙ্ঘন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সোমবার বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায়ও বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘আমরা প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের বন্ধুত্ব চাই, কিন্তু খবরদারি নয়।’
ত্রিপুরায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার যে অভিযোগ করেছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। বরং সম্মিলিত সনাতন জগরণী জোটের অনুসারীদের হাতে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে একজন আইনজীবী নিহত হওয়ার পরও সেখানে কোনো অঘটন ঘটতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সচেতন ও দায়িত্বশীল অবস্থানের কারণে। আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে সংঘটিত হামলার প্রতিবাদে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে, তাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিপুলসংখ্যক সদস্যও যোগ দিয়েছেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগরতলার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে। আগরতলা মিশনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা তিন পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে দিল্লির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। কিন্তু ভারতের এই পদক্ষেপ উত্তেজনা প্রশমনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে কি না, সেটা বলা কঠিন। কারণ, ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও স্বৈরাচারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের প্রতি ভারত ধারাবাহিকভাবে যে আচরণ করে আসছে, তা সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ নয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর পাঠানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরজি কেবল স্ববিরোধী নয়, উসকানিমূলকও। বাংলাদেশে ভারতের কোনো মিশন অভিমুখে বিক্ষুব্ধ মানুষ মিছিল করে গেলেও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি। অথচ ভারতে একের পর এক বাংলাদেশ মিশনে হামলা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা বাংলাদেশের দুটি সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে এই দুটি রাজ্যের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ ছাড়াও দুই দেশের মানুষের রয়েছে দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক বন্ধন। অথচ আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, দেশটির ভোটের রাজনীতিতে বাংলাদেশকেই বারবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। এ কারণেই কি বাংলাদেশের বন্ধুত্বের দাবিদার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের উদ্ভট প্রস্তাব হাজির করলেন?
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ভারতের আচরণ দেখে এটা স্পষ্ট যে তারা একে মেনে নিতে পারেনি। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা মুখে বন্ধুত্বের কথা বললেও বাস্তবে তাদের অনেকের মধ্যে বৈরী আচরণই বেশি লক্ষণীয়। আগরতলার হোটেলমালিকেরা যখন সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশি পর্যটকদের জায়গা দেবেন না, কিংবা কলকাতার কোনো হাসপাতাল যখন বাংলাদেশি রোগীকে চিকিৎসাসেবা না দেওয়ার ঘোষণা দেয়, তখন এটাকে সর্বাত্মক অসহযোগিতা হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।
আমরা আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং সব ধরনের উসকানিমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানাই।