১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম আলো যাত্রা শুরু করেছিল স্বাধীন ও সৎ সাংবাদিকতার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। গত দুই যুগে আমাদের এই যাত্রা সহজ ছিল না। প্রথম থেকেই নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রথম আলোকে।
বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই প্রবলভাবে বিভক্ত, অস্থির, অনিশ্চিত ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। বিরোধী দলে থাকতে যাঁরা গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য উচ্চকণ্ঠ থাকেন, ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরা তা অনেকটাই ভুলে যান।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে ন্যূনতম কর্ম সম্পর্ক থাকা দরকার, তারও অনুপস্থিতি লক্ষ করছি প্রতিনিয়ত।
বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও আমরা গণতন্ত্রকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে পারিনি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। নির্বাচন কীভাবে হবে, সে বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্যে আসতে পারেনি। তদুপরি পূর্বাপর সরকারগুলো একের পর এক আইন জারি করে মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করে দিতে তৎপর থেকেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দৃশ্যত যত বিভেদ থাকুক না কেন, এ বিষয়ে তাদের মধ্যে আশ্চর্য সহমত দেখা যায়। স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ।
সংবাদমাধ্যমের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি প্রযুক্তিগত। প্রথম আলো যখন যাত্রা শুরু করে, তখন মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমই প্রধান ভূমিকায় ছিল। পরে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন মাধ্যমটি সামনের সারিতে চলে আসে। বর্তমানে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের তথ্য পেলেও তার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন আছে; অনেক ক্ষেত্রে তথ্য দেওয়ার নামে গুজব ছড়ানো হয়।
ফলে এগুলো মুদ্রিত সংবাদপত্র ও মূলধারার অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। বরং এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রথম আলো আরও বেশি সংখ্যক পাঠকের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠালগ্নে স্বাধীন ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ ছিল, আজও সেগুলো রয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, কিছু বাড়তি চ্যালেঞ্জও যুক্ত হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের কালাকানুনটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অতি সম্প্রতি প্রেস কাউন্সিল আইনের যে খসড়া মন্ত্রিপরিষদ নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে এবং ওটিটি নীতিমালা ও উপাত্ত সুরক্ষা আইন করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা-ও পরোক্ষভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য হুমকি।
এত সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রথম আলো সৎ, বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার নীতিতে অটল রয়েছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার এবং অসাম্প্রদায়িকতার নীতিতে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে প্রথম আলো এগিয়ে যাবে। দুই যুগপূর্তিতে আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে প্রতিদিন প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার পাঠকসংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। আর ১ কোটি ৫০ লাখ অনলাইন ইউজার এবং ২৫ কোটি পেজভিউ নিয়ে প্রথম আলো এখন পৃথিবীর শীর্ষতম বাংলা সংবাদমাধ্যম।
প্রথম আলো সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এবং নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করার পাশাপাশি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ে সব ভালো উদ্যোগ ও কর্মতৎপরতার খবরও পাঠকের সামনে তুলে ধরে। একটি সহিষ্ণু, গণতান্ত্রিক, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে এই প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।
প্রথম আলোর জন্মদিনটি বাংলাদেশের সংবিধানেরও জন্মদিন। সংবিধানে বর্ণিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রথম আলো নিরন্তর লড়াই করে আসছে; যার জন্য পত্রিকা হিসেবে প্রথম আলো এবং এর সাংবাদিকদের নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
তারপরও আমরা আমাদের অবস্থানে অনড় আছি, থাকব। স্বাধীন সাংবাদিকতার এই লড়াইয়ে অগণিত পাঠকই আমাদের প্রেরণা।
দুই যুগপূর্তিতে আমরা প্রথম আলোর পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, পরিবেশক, হকারসহ সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই।