এমনিতেই যানজটের কারণে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর। এ শহরের সড়কে ছোট-বড়, ধীর-দ্রুতগতি মিলিয়ে ১৮ সংস্করণের যান চলাচল করায় ন্যূনতম শৃঙ্খলা রাখাটা অত্যন্ত কঠিন। এ পরিস্থিতি আরও নাজুক ও ভয়াবহ হয়ে ওঠে কোনো সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সড়ক বন্ধ করে দাবিদাওয়া জানানোর প্রবণতা এমনিতেই বেড়েছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাত্র, শ্রমিক, চাকরিপ্রার্থীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষকে তাদের বঞ্চনার প্রতিকার দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই শাহবাগ, প্রেসক্লাব, সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনের সড়কসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করতে দেখা যাচ্ছে। ফলে যানজটে নাকাল নগরবাসীর জীবনে দুর্বিষহ ভোগান্তি নেমে আসছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির তৃতীয় সভায় রাজধানীর শাহবাগের পরিবর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা ও সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, নাগরিকদের জনভোগান্তি দূর করতে এ সিদ্ধান্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। কেননা শাহবাগ রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এ সড়ক বন্ধ করে দেওয়া মানে হচ্ছে পুরো ঢাকা শহর স্থবির হয়ে যাওয়া। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বারডেম হাসপাতালের অবস্থান এখানে। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার অন্যতম পথ এটি। এই তিন হাসপাতালে দেশের জটিল এ সংকটাপন্ন রোগীদের একটা বড় অংশের চিকিৎসা হয়। সড়ক বন্ধ থাকলে সময়মতো তাদের চিকিৎসাসেবা পাওয়াটা ব্যাহত হয়, যা সভ্য সমাজে অকল্পনীয়।
যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজে সভা-সমাবেশ, প্রতিবাদ এবং শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবিদাওয়া জানানো সব নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, সড়ক বন্ধ রেখে অন্য নাগরিকদের ভোগান্তিতে ফেলাটাও অগ্রহণযোগ্য।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সড়ক বন্ধ করে সভা-সমাবেশ করার চর্চা বহু বছর ধরে চলে আসছে। এ চর্চা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। যেকোনো নগরে সভা-সমাবেশ করা কিংবা প্রতিবাদ জানানোর জন্য আলাদা জায়গা থাকা অত্যাবশ্যক। আধুনিক নগর–পরিকল্পনায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একসময় রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ গিয়ে তাদের দাবিদওয়া জানাত। সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকা শহরে সভা-সমাবেশ করার জন্য আলাদা কোনো জায়গা নেই বললেই চলে। প্রেসক্লাবের সামনে নাগরিকদের বিভিন্ন অংশ তাদের দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছে। কিন্তু সেখানে একটু বড় জমায়েত হলে যান চলাচলে সমস্যা তৈরি হয়। ফলে জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
শাহবাগের পরিবর্তে সোহওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা ও সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে জনভোগান্তি কমবে বলবে আমরা আশা করি। সে ক্ষেত্রে নাগরিকেরা নিরাপদ পরিবেশ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাতে নিজেদের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পারেন, সে জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে উদ্যানের প্রাণপ্রকৃতি ও পরিবেশের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। একই সময়ে একাধিক সমাবেশ হলে সেখানে যাতে শৃঙ্খলা বজায় থাকে, সে ব্যবস্থাও নিতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন–আকাঙ্ক্ষা সামনে নিয়ে এসেছে। এ বিবেচনায় বিশৃঙ্খল রাজধানীকে ন্যূনতম শৃঙ্খলার মধ্যে আনা সবার জন্যই গুরুদায়িত্ব। শাহবাগে সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সহযোগিতা জরুরি।