নব্বইয়ের দশকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে কয়েকজন লেখক-বুদ্ধিজীবীর উদ্যোগে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল এখনো গেল না আঁধার শিরোনামে। সরকারের প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইনের নতুন খসড়া সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরও সরকার তার অবস্থান থেকে খুব একটা সরে আসেনি। যদিও উপাত্ত দেশে রাখার ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা আনা হয়েছে।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, নতুন খসড়ায়ও নির্বাহী বিভাগের অগাধ ক্ষমতা রাখা হয়েছে। সরকার চাইলেই উপাত্ত নেওয়া, মানবাধিকার ও বাক্স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকির মতো বেশ কিছু বিষয় আছে এতে।
উল্লেখ্য, সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি) আইনটির নতুন খসড়া গত মঙ্গলবার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। এর আগে আইসিটি বিভাগ গত বছরের মার্চে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া প্রথমবারের মতো মতামত নেওয়ার জন্য ওয়েবসাইটে দিয়েছিল। এরপর কয়েকটি খসড়া হয়েছে।
সেগুলোর ওপর দেশি ও বিদেশি সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন, দূতাবাস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে মতামত ও পর্যবেক্ষণ জানানো হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদেরা বলেছেন, ওয়েবসাইটে খসড়াটি দিয়ে সরকার আইনের পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করেছে। তবে খসড়াটি এখনো অনেক বেশি বিধিনির্ভর। আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড কী হবে, তা খসড়ায় উল্লেখ নেই।
নতুন খসড়ায় উপাত্ত স্থানীয়করণের কথা বলা হলেও আন্তরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট করা অন্য কোনো বিষয়ের প্রয়োজনে উপাত্ত স্থানান্তরের সুযোগ রাখা হয়েছে। এটা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ কিছুটা কমাতে পারে। অংশীজনদের দাবি ছিল, আইনটি কার্যকরের ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তুতির সময় দেওয়া। নতুন খসড়ায় আইনটি পাস হওয়ার পর তিন বছর পর্যন্ত কার্যকর করার সময় দেওয়া হয়েছে।
নতুন খসড়ায় উদ্বেগের প্রধান দিক হলো উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক নিয়ন্ত্রক, প্রক্রিয়াকারী বা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সরবরাহ করার নির্দেশ দিতে পারবেন। সরকার চাইলে যেকোনো উপাত্ত নিতে পারবে। উপাত্ত সুরক্ষা আইনের অধীনে স্বাধীন উপাত্ত সুরক্ষা সংস্থা (এজেন্সি) গঠনের সুপারিশ এসেছিল বিভিন্ন সংস্থা থেকে। কিন্তু সরকার আর পাঁচটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো পৃথক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করার প্রস্তাব দিয়েছে।
বাংলাদেশে স্বাধীন সংস্থাগুলোই যেখানে সরকারের খয়ের খাঁ হিসেবে কাজ করে থাকে, সেখানে প্রস্তাবিত সরকারি সংস্থা যে নাগরিকদের সুরক্ষা দেবে না, তা হলফ করে বলা যায়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিক্ত অভিজ্ঞতা জনমনে অনেক বেশি শঙ্কা তৈরি করেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্ষমতাসীনেরা এটা বুঝতে পারে না যে কোনো দিন ক্ষমতার বাইরে গেলে তারাই এই আইনের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হতে পারে।
কোনো ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘিত হলে তিনি সরাসরি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন না বলে খসড়ায় বিধান রাখা হয়েছে, সেটি সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী।
উপাত্ত সুরক্ষা আইন নিয়ে নাগরিক সমাজের উদ্বেগ যে কাটেনি, তা বোঝা যায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে। তাঁরা এ নিয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আবার বৈঠক করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
দেশের স্বার্থ রক্ষার নামে ব্যক্তির অধিকার খর্ব করা যাবে না। বর্তমান ডিজিটাল ব্যবস্থা একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা—এই সত্য মেনে নিয়েও আমাদের সাফ কথা হলো, উপাত্ত সুরক্ষা আইনে এমন কোনো বিধি রাখা যাবে না, যাতে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হরণ হয়; ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।