মানবাধিকার রক্ষায় এক ধাপ অগ্রগতি

সম্পাদকীয়

এ বছর আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী দিবসের আগের দিন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই করেছেন। বাংলাদেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের সন্ধান চেয়ে প্রতিকার পাননি। এ বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের হস্তক্ষেপও কোনো কাজে লাগেনি। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়া ও গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন কিছুটা হলেও ভুক্তভোগীদের আশ্বস্ত করতে পারবে।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে যুক্ত হওয়ার দাবি জানিয়ে এলেও অতীতে কোনো সরকার তাতে সই করেনি। অন্তর্বর্তী সরকার সেই আরাধ্য কাজটি সম্পন্ন করল। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের ঘটনা তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ওই কমিশন গঠন করেছে সরকার। কমিশনকে তদন্ত করে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এই কমিশন পুলিশ, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্যের হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান করবে।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুমের ঘটনা নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপকভাবে আলোচনা–সমালোচনা চলে আসছিল। যদিও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের কথা বরাবরই অস্বীকার করে গেছেন। জাতিসংঘের দেওয়া তালিকার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন করেছিলেন তাঁরা। আওয়ামী লীগ আমলে সংঘটিত গুমের ঘটনা নিয়ে একটি সংবাদমাধ্যম ‘আয়নাঘর’ নামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিল।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় আট বছর পর গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্ত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। এ ছাড়া পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা পাঁচ বছর পর গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্ত হন।

এদিকে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাক ১৮ আগস্ট বিভিন্ন সময় গুমের শিকার ১৫৮ ব্যক্তির একটি তালিকা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালকের কাছে দিয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় গুমের শিকার ৭৬ জনের একটি তালিকা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিল।

গত সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং ‘আয়নাঘরের’ মতো চরম ঘৃণ্য অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।

আমরা আশা করব, তদন্ত কমিশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সত্য উদ্‌ঘাটনে সক্ষম হবে। এতে ভুক্তভোগীরা যদি তাঁদের প্রিয়জনদের ফিরে পান, সেটাই হবে বড় পাওয়া। একটি গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্নমত প্রকাশ কিংবা সরকারের বিরোধিতার কারণে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে কোনো নাগরিক গুম হবেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সরকার ও রাষ্ট্র এক নয়। এমনকি কেউ রাষ্ট্রের বিরোধিতা করলেও আইনানুগ তার বিচার হবে। তাঁকে গুম করা হবে কেন?

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশের সই করা মানবাধিকার রক্ষায় এক ধাপ অগ্রগতি। এটি ধরে রাখতে হলে অতীতের গুমের ঘটনাগুলো অনুসন্ধানের পাশাপাশি রাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে ভবিষ্যতে কেউ গুমের শিকার হবেন না।