কোভিড-১৯-এর উৎস অজানা ছিল বলে এর সংক্রমণ আমরা ঠেকাতে পারিনি। বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশই ঠেকাতে পারেনি। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এ যুক্তি খাটে না।
ডেঙ্গুর উৎস এডিস মশার জন্ম রোধ করতে পারলে ডেঙ্গু সহজেই নির্মূল করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বহু উদ্যোগ-আয়োজন, সুপারিশ, সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কাজ হয়েছে কম। ফলে ডেঙ্গু নিয়ে আগে যে দুর্ভাবনা ছিল, তা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের দুটি উপায় আছে। প্রথমত, ডেঙ্গুর উৎস এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করা। সাধারণত ঘর, বারান্দা, ছাদ কিংবা বাড়ির আশপাশে কোথাও পানি জমে থাকলে সেখানে এডিস মশা জন্ম নেয়।
ফুলের টব, টবের নিচে রাখা প্লেট, বালতি, অব্যবহৃত তৈজস প্রভৃতিতে পানি জমে থাকলে এর বংশবিস্তার ঘটে থাকে। এডিসের প্রজননক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করে আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে পারি। দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তাকে সুস্থ করে তোলা। প্রথম কাজটি ভালোভাবে করতে পারলে চিকিৎসাসেবা নিয়ে খুব ভাবতে হয় না।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের দুই–তৃতীয়াংশ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এর কারণ আমরা এডিসের প্রজননক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করতে পারিনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার বর্ষাকালীন মশা জরিপে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৩ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১২ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট পাওয়া গেছে।
যে শহরের ১০-১২ শতাংশ বাড়িতে এডিসের লার্ভা থাকে, সেই শহরে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব নয়। ঢাকা শহরের মশা রোধের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। তারা বাড়ির আঙিনায় ওষুধ ছিটানোর রুটিনমাফিক কাজ করে। অথচ এডিস মশার জন্ম হয় বাসাবাড়ির ভেতরে।
২০১৭ সালে দেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় বহু মানুষ আক্রান্ত হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগতত্ত্ববিদ কে কৃষ্ণমূর্তি পরিস্থিতি সরেজমিন পর্যবেক্ষণের জন্য এসেছিলেন। তিনি ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোধে ২২ পৃষ্ঠার একটি পরিকল্পনা দলিলও তৈরি করেছিলেন, যা ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ যথার্থই বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ে অতীতে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা যেসব সুপারিশ করেছেন বা পরামর্শ দিয়েছেন, তার কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করা হয়নি।
যদি বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ ও পরামর্শই বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ হবে কীভাবে? দুই–তৃতীয়াংশ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার খবর জানা গেলেও আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা জানা যায়নি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। আর মারা গেছেন ৪৫ জন। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে, যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে তার চার গুণ।
কলকাতা সিটি করপোরেশন এলাকায়ও একসময় ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল। তারা এটা প্রায় শূন্যে নিয়ে এলেও আমরা পারলাম না। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু বাংলাদেশে বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে থাকার পরও এর নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে করি।
স্বাস্থ্য বিভাগ, না সিটি করপোরেশন দায়ী—সেই বিতর্কে না গিয়েও বলতে চাই, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া হোক। যাদের এসব সুপারিশ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হোক। সেই সঙ্গে নাগরিক সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।