হামলা-নাশকতা রোধে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিন

সম্পাদকীয়

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশে কার্যত কোনো সরকার নেই। এমন একটি পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে যে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলার যে ঘটনা ঘটছে, তা অগ্রহণযোগ্য। শিক্ষার্থী ও সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, এসব ঘটনা সেই অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে।

সোমবার সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দেশবাসীর সহযোগিতা চেয়েছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি অবিলম্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনেরও ঘোষণা দেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনও তাঁর ভাষণে দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী গতকাল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে জরুরি হয়ে পড়েছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু কাজটি করবে কে?

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব মূলত পুলিশের। কিন্তু তারা এখন প্রায় নিষ্ক্রিয়। ৬ আগস্ট পুলিশের অধস্তন কর্মচারী সংগঠন দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি ঘোষণা করেছে। তাদের অভিযোগ, যেভাবে থানা-পুলিশের ওপর নির্বিচার হামলা হচ্ছে, একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছে, সেখানে তাদের পক্ষে পেশাগত দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশ বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। উল্লেখ্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বেশির ভাগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিরাপত্তার ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। আর অধস্তনেরা কর্মবিরতি পালন করছেন।

এ অবস্থায় দেশের বিভিন্ন স্থানে যে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে, তা মোকাবিলার কেউ নেই। ক্ষমতাত্যাগী আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী অন্যায় করলে আইনানুযায়ী তার বিচার হবে। কিন্তু দলীয় অফিস, নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করার পাশাপাশি অধিকাংশ জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর জনগণের জানমাল রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গণভবন, পুলিশের সদর দপ্তরসহ বহু সরকারি স্থাপনায় নির্বিচার হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিবিশেষের নয়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাদুঘরে আগুন দেওয়া কিংবা বিভিন্ন স্থানে তাঁর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা চরম গর্হিত কাজ। ইতিমধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশে কোনো ভাস্কর্য থাকবে না বলেও স্লোগান দিচ্ছেন, যার পেছনে মহলবিশেষের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকা অসম্ভব নয়।

বাংলাদেশে যেকোনো রাজনৈতিক সংঘাতে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষই বেশি আক্রান্ত হন। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অবিলম্বে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা রোধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে কিছু কর্মকর্তার ফোন নম্বর দিয়ে কোথাও কেউ আক্রান্ত হলে খবর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আক্রান্ত হওয়ার পর খবর দিলে খুব লাভ হওয়ার সুযোগ নেই। সশস্ত্র বাহিনীকে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে আগাম পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কেউ আক্রমণ করতে না পারে।

রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবক। সেনাপ্রধান সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলেছেন। আমরা মনে করি, সেনাবাহিনীর উচিত জোরালোভাবে সেই দায়িত্ব পালন করা। পুলিশের অনুপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা কোনো কোনো স্থানে ট্রাফিকব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন। জাতীয় সংসদ ভবন পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রতীকী হিসেবে এগুলো ভালো কাজ। কিন্তু জনগণের জানমালের সুরক্ষা দিতে প্রতিটি এলাকায় জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি প্রয়োজন সর্বাত্মক প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ।