আমাদের ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায় ছিল গেল শতকের ষাটের দশক। এই সময়ে শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন পেরিয়ে আসে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। সেই সময়ে যেসব তরুণ নেতা পাকিস্তানি শাসকদের জেল-জুলুম উপেক্ষা করে বাম রাজনীতির দীপশিখা প্রজ্বালন করেছেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন এবং পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা হিসেবে এ দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ‘ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন’–এর যৌথ বাহিনী গড়ে তোলায়ও তাঁর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ছিল।
বর্তমান সরকার যখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই বাহিনীকে স্বীকৃতি দিচ্ছিল না, আইনি লড়াই করে পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও তাঁর সহযাত্রীরা সেই স্বীকৃতি আদায় করেন।
স্বাধীনতার পর পঙ্কজ ভট্টাচার্য ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জীবনসায়াহ্নে এসে বহুধাবিভক্ত ন্যাপের ঐক্য গড়ে তোলার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঐক্য ন্যাপ; যদিও সেই প্রয়াস পুরোপুরি সফল হয়েছে বলা যাবে না। রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনেও ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
যেখানেই অন্যায়-অত্যাচার দেখেছেন, সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি দেখেছেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছুটে গেছেন, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে নিয়ে প্রতিকারের চেষ্টা করেছেন।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য মোট চারবার জেল খেটেছেন। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৬৭ সালে আনা হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা’র অভিযোগ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনেও তাঁর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত পঙ্কজ ভট্টাচার্যের বই আমার সেই সব দিন-এ একজন নিবেদিতপ্রাণ ও সংগ্রামী রাজনীতিকের পরিচয় পাওয়া যায়।
তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, যে দলই করুন না কেন, নীতি ও আদর্শে ছিলেন অবিচল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এই রাজনীতিক।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য ৮৪ বছর বেঁচে ছিলেন। যেকোনো মানুষের জন্য এটি একটি পরিণত বয়স হিসেবেই বিবেচিত। কিন্তু তারপরও বলব, তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি নির্দিষ্ট দলের রাজনীতি করতেন, কিন্তু দলীয় সংকীর্ণতা থেকে বরাবর নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন। তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
পঙ্কজ ভট্টাচার্যের কর্ম ও আদর্শ হোক আমাদের উজ্জ্বল পাথেয়।