মালিক-শ্রমিক পক্ষের ‘মামাবাড়ির আবদার’

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের পক্ষ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো চিঠিতে যে ১১ দফা দাবির কথা বলা হয়েছে, তা কেবল অযৌক্তিক নয়, সড়কে নতুন করে আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টাও। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ও দুর্ঘটনা কমাতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, এ চিঠিতে তার কোনো কোনোটি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, কোনো কোনোটি পরোক্ষভাবে।

ঢাকা শহরের বাস চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অনেক আগেই রুট পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের বিরোধিতায় সেটি কার্যকর করা যায়নি। অনেক আলোচনার পর এ পর্যন্ত তিনটি রুটে সমন্বিত পদ্ধতিতে বাস চালু হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য রুটেও চালু হওয়ার কথা আছে। এর আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হক হাতিরঝিল-গুলশান রুটে এই পদ্ধতিতে বাস চালু করেছিলেন, যার সুফল যাত্রীসাধারণও পাচ্ছেন।

ঢাকার বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন কোম্পানির বাস চলাচল করায় পরিবহনে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে দুই কোম্পানির বাসের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে দুই কলেজশিক্ষার্থী নিহত হন। এ ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং সরকার সড়ক পরিবহন আইন করতে বাধ্য হয়।

এখন মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের নেতারা সড়ক পরিবহন আইন শিথিল করার পাশাপাশি ঢাকার পুনর্বিন্যাসিত রুটে অন্যান্য কোম্পানির বাস চালানোর সুযোগ দেওয়ার যে দাবি জানিয়েছেন, যা মামাবাড়ির আবদার ছাড়া কিছু নয়। তাঁদের অন্যান্য দাবির মধ্যে আছে দুর্ঘটনার কারণে চালকদের শাস্তি কমানো এবং ঢাকা শহরের বাইরে টার্মিনাল না হওয়া পর্যন্ত শহরের বাস কাউন্টারগুলো বন্ধ না করা।

যেসব কারণে ঢাকা শহরে যানজট হচ্ছে, তার অন্যতম হলো যত্রতত্র বাস কাউন্টার। এর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বাধীন রুট রেশনালাইজেশন কমিটি ঘোষণা দিয়েছিল যে আগামী ১ এপ্রিলের পর ঢাকায় টার্মিনালের বাইরে আর কোনো কাউন্টার রাখা যাবে না।

সমন্বয় পরিষদের চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগের দুর্দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে এবং ২০১৪-১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনায় সরকারের পক্ষে ঢাকা শহরে চলাচলকারী গাড়ির মালিক-শ্রমিকেরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।’ এতে সই করেন জাতীয় সংসদের একাধিক সদস্য, যাঁরা সংসদে পরিবহন আইন অনুমোদনেও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁরা এখন নিজেদের তৈরি আইন নিজেরাই ভাঙতে চাইছেন।

পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতারা এখন এ বিশেষ ভূমিকার ‘প্রতিদান’ হিসেবে সরকারের কাছ থেকে অন্যায্য সুবিধা আদায় করতে চাইছেন। কিন্তু সরকারকে মনে রাখতে হবে যে স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে যাত্রীসাধারণ, তথা ঢাকার বাসিন্দারা জিম্মি হতে পারেন না। পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের কোনো সংগঠনের গঠনতন্ত্রে নিশ্চয়ই এ কথা লেখা নেই যে তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে বিশেষ ভূমিকা রাখবেন। যাত্রীসাধারণের সেবা দেওয়া পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের দায়িত্ব।

নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মালিক-শ্রমিকেরা কখনোই সহায়তা করেননি। মালিক-শ্রমিকেরা চাইলেই সব পান, তাঁদের চাওয়ার বাইরে কিছু হয় না। এসব দাবি তুলে তাঁরা সড়কের বিশৃঙ্খলাকে জায়েজ করতে চাইছেন।

সরকারের দায়িত্ব সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা; বিশৃঙ্খলাকে উসকে দেওয়া নয়। নির্বাচন সামনে রেখে সরকার যদি পরিবহনমালিক ও শ্রমিক পক্ষের অন্যায় আবদারের কাছে নতিস্বীকার করে, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না।