ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না বলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে মন্তব্য করেছেন, সেটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গণতন্ত্রের জন্য যেমন নির্বাচন প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐক্যের গুরুত্বও অস্বীকার করা যাবে না।
বেশ কিছুদিন ধরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চললেও এ বিষয়ে পরিষ্কার মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। একদিকে কয়েকটি রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে, অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সংস্কারের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের বক্তব্য হলো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনরাবির্ভাব ঠেকাতে রাষ্ট্রের সংস্কার অপরিহার্য।
এ প্রেক্ষাপটে গত শুক্র ও শনিবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ দুই দিনব্যাপী ‘ঐক্য কোন পথে’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপের আয়োজন করে, যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। এ সংলাপে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাংবাদিক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ যোগ দেন। সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা সংলাপে অংশ নিয়ে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে তাঁদের ভাবনা তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংস্কার বিষয়ে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য প্রয়োজন। এই তিন লক্ষ্যের (নির্বাচন, সংস্কার ও ঐক্য) কোনোটিকে ছাড়া কোনোটি সফল হতে পারবে না।’ আমরা মনে করি, এখানে তিনটি বিষয়কে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হতে গেলে জাতীয় ঐকমত্য, অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক বিষয়ে ন্যূনতম ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার বিকল্প নেই। গত ৫৩ বছরে আমরা সেটি করতে পারিনি। বারবার ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থে সামষ্টিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। এর পুনরাবৃত্তি রোধে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি রোধ করতেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সংস্কার অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। আমরা কোনোভাবে এটা অগ্রাহ্য করতে পারি না। আবার অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ প্রলম্বিত হলে যে নানা সমস্যা দেখা দেয়, সেটাও সবাইকে মনে রাখতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের বিষয়ে দুটি সম্ভাব্য তারিখের কথা বলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো অল্প সংস্কারে রাজি হলে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। আর তারা যদি ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার চায়, তাহলে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। সংস্কার ও নির্বাচন পরস্পরবিরোধী নয়; বরং একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই দেখতে হবে। সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনগুলোর প্রথম ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা। এরপর সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও গঠন করা হয়েছে।
ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের সংলাপে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যে সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে জাতীয় ঐক্যের কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এই সংলাপের পর এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা থাকার কথা নয়। এখন সরকারের দায়িত্ব হলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ন্যূনতম সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে আসা। রাজনৈতিক দলগুলোরও এখানে বড় দায়িত্ব রয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন যেমন জরুরি, তেমনি গণতন্ত্রের জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারও কম জরুরি নয়। জুলাই অভ্যুত্থানে হাজারো প্রাণের আত্মত্যাগে যে জন–আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেখানে এ দেশের মানুষ আর পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায় না।