বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদ যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা সেটিকে স্বাগত জানাই। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানিয়েছে, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইন (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ-২০২৪ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের আইনি যাচাই (ভেটিং) শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২৩ সালে যখন সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণীত হয়, তখনই আমরা এর বিরোধিতা করেছিলাম। আমরা এ–ও বলেছিলাম, ব্যাপকভাবে সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে যে আইন দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, সেটাও নিবর্তনমূলক। বিশেষ করে এই আইনে এমন সব ধারা ছিল, যাতে সরকার যঁাকেই দেশবিরোধী মনে করত, তাঁকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি তাঁর কার্যালয়ে তল্লাশি ও ডিভাইস জব্দ করতে পারত। এর জন্য তথ্যপ্রমাণের প্রয়োজন হতো না। এই আইনের কারণ হিসেবে ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও, ভিন্নমত ও সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধই ছিল আসল উদ্দেশ্য।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর অধীন গত আগস্ট পর্যন্ত দেশের ৮টি সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট ৫ হাজার ৮১৮টি মামলা চলমান। বর্তমানে স্পিচ অফেন্স-সম্পর্কিত মোট ১ হাজার ৩৪০টি মামলা চলমান, যার মধ্যে ৪৬১টি মামলা তদন্তকারী সংস্থার কাছে তদন্তাধীন। ৮৭৯টি মামলা দেশের ৮টি সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাত হাজারের বেশি মামলা হয়েছিল, যার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। এতে প্রমাণিত হয়, বেশির ভাগ মামলা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের পক্ষ থেকে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের জোর দাবি ওঠে। গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘অবশ্যই সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা উচিত। সেদিকেই যাব। আলটিমেট এটা বাতিল হবে।’ গত সপ্তাহে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম আশ্বাস দেন, এ সপ্তাহে এই আইন বাতিল হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া স্পিচ অফেন্স-সম্পর্কিত মামলাগুলো (মুক্ত মতপ্রকাশের কারণে মামলা) প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া এসব মামলায় কেউ গ্রেপ্তার থাকলে তিনি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি পাবেন বলেও জানানো হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলাগুলোকে ‘স্পিচ অফেন্স’ এবং কম্পিউটার হ্যাকিং বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতিকে ‘কম্পিউটার অফেন্স’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্পিচ অফেন্স-সম্পর্কিত মামলাগুলোর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের অধীন ২৭৯টি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন ৭৮৬টি এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীন ২৭৫টি মামলা চলমান আছে।
রাজনৈতিক নেতাদের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা যে ফাঁকা আওয়াজ দেননি, উপদেষ্টা পরিষদের নীতিগত সিদ্ধান্তই তার প্রমাণ। ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে তাঁরা এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন, এ জন্য ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে আমাদের দাবি থাকবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে যেসব মামলা বিচারাধীন, (অন্তত বাক্স্বাধীনতাসংক্রান্ত) সেগুলো পরীক্ষা–নিরীক্ষাপূর্বক দ্রুত প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা হোক।