কম বরাদ্দ দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা কি সম্ভব

সম্পাদকীয়

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারের যে ভূমিকার কথা বলা হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ইউনেসকোর এই গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টে প্রতিবছরই বিভিন্ন দেশের শিক্ষা খাতে সরকার ও ব্যক্তিপর্যায়ের ব্যয়ের জরিপ করা হয়। তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে ব্যয়ের ৭১ শতাংশ বহন করে পরিবার। এর অর্থ, সরকার বহন করে মাত্র ২৯ শতাংশ। তাহলে সরকার এত ঢাকঢোল পিটিয়ে শিক্ষার উন্নয়নের যেসব ফিরিস্তি দিচ্ছে, তা শুভংকরের ফাঁকি কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে, তার মধ্যে উদ্বেগজনক হলো, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে পরিবারকে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। এতে আরও উঠে এসেছে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকার শিক্ষার্থীদের ফি বাবদ যে অর্থ নিয়ে থাকে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তার চেয়ে ৯ গুণ বেশি নিয়ে থাকে।

বাংলাদেশে একসময় প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতা কম ছিল। গ্রামাঞ্চলে একেবারে ছিল না। এখন সে প্রবণতা প্রায় গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সবখানেই ঢুকে পড়ছে। অভিভাবকদের মনে এ ধারণা হয়েছে যে সন্তানকে প্রাইভেট না পড়ালে পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না। অভিভাবকেরা নামকরা কোনো শিক্ষক না পেলে নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছেই সন্তানকে প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন। এতে দুই ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তাদের শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ভাবে, প্রাইভেট টিউটরের কাছে যে পাঠ তারা নেবে, সেখান থেকেই যখন পরীক্ষার প্রশ্ন আসবে, শ্রেণিকক্ষে বাড়তি পাঠ নেওয়ার কী প্রয়োজন?

ইউনেসকোর প্রতিবেদনে যখন শিক্ষায় অভিভাবকের অতিরিক্ত ব্যয় বহনের খবর এসেছে, তখন শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দের একটি পরিসংখ্যানও নেওয়া যেতে পারে। শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা যখন শিক্ষা খাতে বাড়তি বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছিলেন, তখন শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হার ক্রমেই কমে যাওয়ার খবরটি খুবই উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষায় জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করা উচিত। বাস্তবে ব্যবহার করা হচ্ছে ২ শতাংশ। কোনো কোনো বছর তার চেয়েও কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি অনুপাতে শিক্ষা খাতে ১ দশমিক ৮৩ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। গত বছর এই বরাদ্দের হার ছিল ২ দশমিক ৮ শতাংশ।

ইউনেসকোর প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি শিক্ষার মান বাড়ানো এবং জ্ঞানভিত্তিক নতুন শিক্ষাক্রম চালুর কথা বললেও শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। যে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং সিংহভাগ মানুষকে খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হয়, সেই দেশে শিক্ষায় বরাদ্দ না বাড়ানোর বিকল্প নেই।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও এক-চতুর্থাংশ মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকা কোনোভাবেই স্বস্তির খবর নয়। অথচ বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর শ্রীলঙ্কাও শিক্ষার হারে অনেক এগিয়ে গেছে।

শিক্ষামন্ত্রী যে মানসম্মত শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নের জন্য জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ এ খাতে রাখতেই হবে। অনুৎপাদনশীল খাতে ক্রমাগত খরচ না বাড়িয়ে শিক্ষায় বিনিয়োগে বাড়ান।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বাড়ালে তার লভ্যাংশ পাবে গোটা জাতি। আর সবশেষে বলব, সরকার যদি শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষমুখী করতে চায়, তাহলে প্রাইভেট পড়ানো, যে নামেই হোক গাইড বা সহায়ক বই বন্ধ করতেই হবে।