স্বাধীন দেশে প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনীই কাম্য

সম্পাদকীয়

গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যে বৈঠকটি করেছেন, সেটিকে গতানুগতিক বলা যাবে না। সংবাদমাধ্যমের খবর দেখে মনে হয়, দুই পক্ষই বেশ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল এবং খোলামেলাভাবে কথা বলেছে।

পুলিশকে অবহেলা করে, পাশ কাটিয়ে দেশ গড়া যাবে না বলে প্রধান উপদেষ্টা যে মন্তব্য করেছেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, পুলিশ মানে আইন, পুলিশ মানে শৃঙ্খলা। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রেই এই দুটিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিকল্প নেই। কেননা আইন ও শৃঙ্খলা না থাকলে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ একটি আধুনিক রাষ্ট্রের যে মৌলিক উপাদান, তা অর্জন করা যাবে না।

পুলিশের পক্ষ থেকে যেসব দাবিদাওয়ার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে সদস্যদের পেশাগত সুযোগ–সুবিধার বিষয়টিও আছে। অন্যান্য পেশার মানুষের মতো পুলিশ বিভাগেও ওপরের স্তর ও নিচের স্তরের সদস্যদের সুযোগ–সুবিধার ফারাকটি অনেক বেশি। এরপর কিছু মৌলিক ও মানবিক বিষয়ের দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। একজন নারী কর্মকর্তাকে যেখানে পদায়ন করা হবে, সেখানে অবশ্যই ডে–কেয়ার সেন্টার থাকতে হবে। প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের আবাসিক ও যাতায়াত–সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে। এসব বিষয়ে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটাই প্রত্যাশিত।

প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে অতীতের ব্যর্থতা ভুলে পুলিশ সদস্যদের প্রতি সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। কেবল নির্বাচন নয়, সব ক্ষেত্রেই তাদের পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চেয়ে ঊর্ধ্বতনদের দায়িত্ব বেশি। আজ যাঁরা পূর্ববর্তী স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ‘রাজার ইচ্ছায়’ চলেছেন। এই ‘রাজার’ ইচ্ছেয় চলার মানসিকতা থেকে পুলিশ বাহিনীকে বেরিয়ে আসতে হবে।

আইনের সুরক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশে সব ক্ষেত্রে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন বলে আশা করি। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাঁরা আইন দ্বারা পরিচালিত হবেন। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা অতীতের অনিয়ম নিয়ে বুলন্দ আওয়াজ তুলছেন, বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিও তাঁদের কড়া নজর রাখতে হবে। বিভিন্ন স্থানে আইনভঙ্গের ঘটনা ঘটার পরও যখন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন, তখন সাধারণ মানুষের প্রতিকার পাওয়ার কোনো পথ থাকে না।

পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করার দাবি জানানো হয়েছে। এটা জরুরি বলে মনে করি। প্রধান উপদেষ্টা পুলিশ বাহিনীর মনোবল বাড়ানোর জন্য অনেক কথা বলেছেন। আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজে তাঁদের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। আইনশৃঙ্খলা ঠিক না থাকলে কোনো বড় চিন্তাকে যে বাস্তবে রূপ দেওয়া যাবে না, সেই সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।

এর আগে কোনো সরকারপ্রধান পুলিশের সঙ্গে এ রকম খোলামেলা কথা বলেছেন বলে জানা নেই। এখন পুলিশ সদস্যদেরই ঠিক করতে হবে তারা পুরোনো ধারায় চলবেন না নতুন ধারায় নিজেদের তৈরি করবেন। স্বৈরতান্ত্রিক সরকার বিদায় নেওয়ার পরও যে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি এবং যেকোনো বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় যৌথ বাহিনীকে তলব করতে হয়, এটা পুলিশের সক্ষমতার প্রমাণ নয়।

আশা করি, পুলিশ সদস্যরা নিজেদের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার পাশাপাশি পেশাগত দায়িত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থাকবেন। স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনীই কাম্য।