গত এক দশকে দেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোতে বোরোর আবাদ কমে গেলেও রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পানির স্তর নামছেই। বর্ষা মৌসুমেও সেখানে পানির স্তর স্বাভাবিক হচ্ছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষকেরা এর পেছনে বড় দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, বরেন্দ্র এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টিপাত কিংবা বৃষ্টির তীব্রতা কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, সেচসহ অন্যান্য কাজে ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির টেকসই ব্যবহার ও খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্থা কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় দেশের পাঁচটি সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত ছিল। ১৯৮৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ওই অঞ্চলের ৩২৮টি টিউবওয়েলে পানির ওঠানামা পরীক্ষা থেকে উঠে এসেছে, সব জায়গায় পানি সমানভাবে কমছে না।
‘সাসটেইনিং গ্রাউন্ড ওয়াটার ইরিগেশন ফর ফুড সিকিউরিটি ইন দ্য নর্থ-ওয়েস্ট রিজিয়ন অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় পানি ব্যবস্থাপনার বড় দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। আধুনিক পানি ব্যবস্থাপনায় ভূ-উপরিস্থ পানি ও বৃষ্টির পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচসহ দৈনন্দিন কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার চলছে। এর নানামুখী বিরূপ প্রভাব সেখানকার কৃষি, প্রতিবেশ ও জীবনযাপনে পড়ছে। কৃষি উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেছে। ধারণা করা হতো, বোরো চাষের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বোরোর আবাদ ৫০ শতাংশ কমে গেলেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নেমে চলেছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-উপরিস্থ পানির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতকরণে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে ফাইলবন্দী অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ১৯৮৭-৮৮ সালে জাইকা প্রথম উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। এর ওপর ভিত্তি করে ১৯৯৪ সালে প্রথম প্রায় ৪৪৯ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়।
কয়েক দফা সংস্কার ও সময়োপযোগী করার পর ২০১৩ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকার একটি সংশোধিত প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ধানের খেতে সেচের পানি না পেয়ে দুই কৃষকের আত্মহত্যার পর উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পটি আবার আলোচনায় আসে। সর্বশেষ ৭ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে আন্তবৈঠকের পর প্রস্তাবটি আবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে, প্রায় ৭৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি সেচসুবিধা পাবে। মহানন্দা ও পদ্মা নদী থেকে পাম্প দিয়ে পানি উত্তোলন করে খালের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম চলবে। সমন্বিত এই সেচ প্রকল্পে মাছ চাষেরও প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
এটি বাস্তবায়িত হলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে আসবে, তাতে পরিবেশগত বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সাশ্রয় হবে, সেচ খরচও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে আসবে। বর্তমানে এক একর জমিতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে সেচে খরচ হয় ৩৩০০-৬০০০ টাকা।
সেখানে প্রকল্প থেকে কৃষক ১০০-৬০০ টাকা ব্যয়ে সেচসুবিধা পাবেন। এ ছাড়া ধানের উৎপাদন ২ লাখ ১১ হাজার টন ও অন্যান্য শস্যের উৎপাদন ১৭ হাজার টন বৃদ্ধি পাবে।
নতুন গবেষণায় উত্তর-পশ্চিমের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য উঠে এসেছে। ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার শুধু কৃষি ব্যয়ই বাড়াচ্ছে না, উৎপাদনও কমাচ্ছে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ক্ষতিরও কারণ হচ্ছে। পানি নিয়ে কারও কারও অন্যায্য ব্যবসারও সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।