জরুরি নির্গমন সিঁড়িসহ সব ধরনের নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ এবং অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকার পরও গুলশানে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা আমরা দেখতে পেলাম। এপ্রিল, মে ও জুন—শুষ্ক মৌসুমের এই তিন মাসে দেশে অগ্নিকাণ্ডের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ বছর শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই গুলশানের অগ্নিকাণ্ড সতর্ক হওয়ার আগাম বার্তা দিচ্ছে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গুলশানের বহুতল ভবনটিতে আগুন লাগার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কসংকেত (ফায়ার অ্যালার্ম) বেজে ওঠার পরও সেখানকার বেশির ভাগ পরিবার তা আমলে নেয়নি। অন্যদিকে যাঁরা অ্যালার্ম শুনে ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে বের হয়েছেন, তাঁরাও জরুরি নির্গমন সিঁড়ি ব্যবহার করেননি।
অগ্নিকাণ্ডে যে দুজন মারা গেছেন, তাঁরা কেউই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাননি। আগুনের আতঙ্কে ভবনের ১২ তলা থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারা যান। অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ ও গুরুতর আহত হয়ে যে নারী শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তিনি অগ্নিকাণ্ডের সময় লিফট ব্যবহার করছিলেন।
২০২০ সালে পুনর্নির্মিত ভবনটি রাজধানী অঞ্চল কর্তৃপক্ষের অঞ্চল-৪–এর অধীন। রাজউক বলছে, বিধি অনুযায়ী ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে; কোথাও আইনের ব্যত্যয় হয়নি। ভবনটির বাসিন্দারা অগ্নিকাণ্ডের সতর্কসংকেত আমলে নিলে ও জরুরি নির্গমন সিঁড়ি ব্যবহার করলে এ হতাহতের ঘটনা এড়ানো যেত।
এ অগ্নিকাণ্ড থেকে যে বিষয়টি আরও স্পষ্ট সামনে চলে এল, তা হলো শুধু নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ ও আধুনিক অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলেই হবে না, সেগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অগ্নিনিরাপত্তা বিধিগুলোর সঙ্গে নাগরিকদের সচেতন করে তোলা ও অগ্নিকাণ্ড হলে কীভাবে নিরাপদে ভবন থেকে বের হয়ে আসা যাবে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়াও জরুরি।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর ২২ হাজারের বেশি ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০২১ সালে এসব দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় ২ হাজার ৫৮০ জন, আহত হন প্রায় ১২ হাজার মানুষ। অগ্নিকাণ্ডের কারণ বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলছে, দেশে ৮০ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনার পেছনে দায়ী বিদ্যুতের শর্টসার্কিট। গুলশানের বহুতল ভবনটির অগ্নিকাণ্ডের প্রাথমিক উৎস হিসেবে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কথা বলা হচ্ছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান বলেছেন, ভবনের প্রতিটি ফ্ল্যাটে সাজসজ্জায় প্রচুর দাহ্য বস্তু ব্যবহার করা হয়েছিল। বহুতল ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি এড়াতে এ বিষয়টির দিকেও মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
গুলশানের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের সবার জন্য সাবধানবাণী হতে পারে। প্রশস্ত সড়কের পাশে অবস্থিত ভবনে আগুন লাগায় অগ্নিনির্বাপণ দল দ্রুত সেখানে যেতে পেরেছে এবং ক্ষতি তুলনামূলক কম হয়েছে। ঘিঞ্জি এলাকায় সরু কোনো সড়কের পাশে এ রকম দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজ চালানো কঠিন হতো এবং ক্ষয়ক্ষতিও বাড়ত। নিকট অতীতে এর বহু উদাহরণ আছে।
সে ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা পেতে ভবন, সড়ক দুটিই এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে দ্রুত উদ্ধারকাজ চালানো যায়। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি বহুতল ভবন ও শিল্পকারখানায় যেন অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, ভবনে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা থাকাই যথেষ্ট নয়, সেখানকার বাসিন্দাদের সেসবের ব্যবহারবিধিও শেখানো জরুরি। যেসব ভবনে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নেই বা নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মিত হয়েছে, সেসব ভবন চিহ্নিত করে কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে আশা করি।