অর্থনীতির চালিকা শক্তি ব্যবসা–বাণিজ্যকে পেছনে রেখে যে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়া যাবে না, এ কথা অমোঘ সত্য। কঠিন বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের ব্যবসা–বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বহুমুখী সমস্যা আছে। যতই দিন যাচ্ছে, ব্যবসা–বাণিজ্যের সমস্যা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে বারবার আশ্বাস পাওয়া গেলেও বাস্তবে সহায়তা মিলেছে সামান্যই।
গত শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের পূর্বাভাস: প্রত্যাশা ও অগ্রাধিকার’ শীর্ষক বাণিজ্য সম্মেলনে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা–বাণিজ্যের সমস্যা ও সংকট তুলে ধরেছেন। এই মুহূর্তে ব্যবসা–বাণিজ্যের সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গ্যাস–বিদ্যুতের সংকট, ঘুষ–দুর্নীতি, সুদের উচ্চ হার, ব্যবসা চালাতে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা। এর মধ্যে ব্যাংকে ঋণপত্র খোলার সংকট কিছুটা কেটেছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক।
কিন্তু ব্যবসা–বাণিজ্যে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া। শিল্পাঞ্চলে প্রায়ই শ্রমিক বিক্ষোভ, অবরোধ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রপ্তানিমুখী শিল্প উদ্যোক্তারা। তাঁরা সময়মতো তাঁদের পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না। বেশ কিছু ক্ষেত্রে কার্যাদেশ বাতিলের ঘটনাও ঘটেছে। উদ্বেগের খবর হলো, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রহরাধীন অবস্থায় একজন ব্যবসায়ীকে মারধর করার ঘটনা। ব্যবসায়ীরা শিল্পাঞ্চল ও পরিবহনে পূর্ণ নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের আরেকটি উদ্বেগের কারণ, ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে হত্যা মামলার আসামি করার ঘটনা।
ব্যবসায়ীদের এসব অভিযোগের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন যেসব আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে ব্যবসায়ীরা কতটা আশ্বস্ত হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। উপদেষ্টা ও সরকারের অন্য নীতিনির্ধারকেরা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চুরি–দুর্নীতির যে ফিরিস্তি দিয়েছেন, সেটা সর্বৈব সত্য। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, আমরা তাকে স্বাগত জানাই।
কিন্তু ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ তো কেবল ব্যাংকিং খাত নয়। গ্যাস–বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে শুরু করে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পরও সরকারি প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে বলা যাবে না। এখনো ব্যবসায়ীদের সরকারি সেবা নিতে ঘুষ দিতে হয়। অর্থাৎ প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বদল হলেও চরিত্র বদল হয়নি।
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আমরাও একমত যে তিন বা চার মাসের মধ্যে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন। গ্যাস–সংকটের যে সহজ সমাধান নেই। কিন্তু এত দিনেও সরকার শিল্পাঞ্চলে কেন স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে পারল না, সেটি বড় প্রশ্ন বটে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ও ন্যায্য সুযোগ–সুবিধার বিষয়টি জড়িত। বাণিজ্য উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের নিজেদের ভূমিকা রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। এর মাধ্যমে যদি তিনি শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষায় মালিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকার কথা বলে থাকেন, সেটি সমর্থনযোগ্য। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের, সেটি বিস্মৃত হওয়া যাবে না।
ব্যাংকে তারল্যসংকটের জন্য অতীত সরকারকে দায়ী করা গেলেও বর্তমানের চাঁদাবাজি–ঘুষের দায় নেবে কে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চেহারা বদল হলেও চরিত্র বদল হয়নি। বর্তমানে ব্যবসা–বাণিজ্যে যে স্থবিরতা চলছে, সেটি কাটিয়ে উঠতে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমস্যাগুলো সমাধান করতেই হবে।