তদন্ত ও মরদেহ ফেরত দিতে বিলম্ব কেন?

সম্পাদকীয়

বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনে পুড়ে যে চার নারী-পুরুষ মারা গেলেন, তাঁদের মরদেহ স্বজনেরা এখনো ফেরত পাননি। ৫ জানুয়ারি ট্রেনটি বেনাপোল থেকে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছার কিছুক্ষণ আগে আগুন লাগলে অন্যরা বেরিয়ে আসতে পারলেও চারজন পুড়ে মারা যান।

তাঁদের শরীর পুড়ে প্রায় অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় ময়নাতদন্তে পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। এ অবস্থায় ডিএনএ পরীক্ষার পরই মরদেহ স্বজনদের ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

প্রশ্ন হলো শুক্রবার ট্রেনের আগুনে চারজন পুড়ে মারা গেলেও চার দিনেও কেন সবার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা গেল না? যখন কর্তৃপক্ষ জানতে পারল, ময়নাতদন্তে কিছু বেরিয়ে আসবে না, তখন দ্রুতই ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। নিহত চারজনের আত্মীয়স্বজন জানেন, তাঁদের প্রিয়জনকে কখনো ফিরে পাবেন না। কিন্তু প্রিয়জনের মরদেহ দ্রুত পাওয়ার অধিকার তো আছে। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তের পর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে।

কোথাও কোনো ট্রেন দুর্ঘটনা হলে কিংবা আগুনে পুড়লে সরকার ও বিরোধী দল একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দায়মুক্তির চেষ্টা করে। এসব নাশকতার ঘটনায় সাধারণ মানুষ মারা যান, স্বজন ও সম্পদ হারান। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক কিংবা রাজনীতির কুশীলবের কিছু হয় না। রাজনীতি কেন এত নৃশংস ও নিষ্ঠুর হবে?

গোপীবাগে ট্রেনে আগুন লাগার কয়েক সপ্তাহ আগে তেজগাঁওয়েও মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন লেগে মা-শিশুসহ চারজন মারা যান, সেই ঘটনার তদন্তও শেষ হয়নি। এটা কি কর্তৃপক্ষের অবহেলা না স্বেচ্ছাকৃত?

গোপীবাগের ঘটনার পরদিন বিএনপির কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে ট্রেনে আগুন দেওয়ার পরিকল্পনাও উদ্‌ঘাটন করেছে অতি তৎপর গোয়েন্দা বিভাগ। এর আগে গাজীপুরে রেললাইনের পাত কেটে ফেলার ঘটনায় বিরোধী দলের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু তেজগাঁওয়ের ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নীরবতা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তাহলে কি এ ঘটনার পেছনে এমন কেউ আছে, যাদের নাম সরকার প্রকাশ করতে চায় না।

ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনা নিয়ে বিরোধী দল দুই ক্ষেত্রেই বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানিয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তদন্ত করা, যা অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তদন্তের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলে সত্য আড়ালে পড়ে যায়। অতীতেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। আবার ঘটনা না ঘটলেও গায়েবি মামলা দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টাও কম হয়নি। দুটিই নিন্দনীয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারা জঘন্য অপরাধ।

নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে ট্রেনে আগুনের ঘটনা ঘটার পরও কর্তৃপক্ষ কেন সজাগ হলো না? কেন ট্রেনে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? উদ্বেগজনক খবর হলো, আগুনে পোড়া দুই ট্রেনে ও সংশ্লিষ্ট রেলস্টেশনে সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকা। সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকলে কীভাবে তারা আগুন-সন্ত্রাসীদের ধরবে?

গোপীবাগে ট্রেনে যাঁরা পুড়ে মারা গেছেন, তাঁরা আর কখনো ফিরে আসবেন না। স্বজনেরা তাঁদের মরদেহ ফেরত চান। এ বিষয়ে বিলম্ব করার অর্থ আগুন-সন্ত্রাসের শিকার মানুষগুলো ও তাঁদের স্বজনদের প্রতি অসম্মান। অবিলম্বে নিহত ব্যক্তিদের ডিএনএ টেস্ট করে স্বজনদের কাছে ফেরত দেওয়া হোক। নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতিই হয়তো তাঁদের সারা জীবনের সম্বল হয়ে থাকবে।