বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পেছানোর খবরটি খুবই উদ্বেগজনক। গত কয়েক বছর স্বাধীনতার সূচক নিম্নগামী হওয়ার প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, এবার সূচক ঊর্ধ্বগামী হবে। আর সেটা না হলেও অন্তত আর নিচে নামবে না। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটাই ঘটল।
প্রতিবছর ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করে। ২০২৪ সালের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম, স্কোর ২৭ দশমিক ৬৪। ২০২৩ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৩তম। স্কোর ৩৫ দশমিক ৩১। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের বড় অবনমন ঘটেছিল ২০২২ সালে, আগের বছরের তুলনায় ১০ ধাপ অবনমন হয়েছিল।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের এই অবনমনের প্রধান কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)। আরএসএফের মতে, বাংলাদেশের ডিএসএ সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বে সবচেয়ে কঠোর আইনগুলোর একটি। সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের প্রতিবাদের মুখে সরকার গত বছর আইনটি বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে যে নতুন আইন করেছে, তাতে জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হলেও দুটির মধ্যে চরিত্রগত ফারাক নেই।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ২৯০ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। হামলার শিকার হয়েছেন ২৮ জন এবং পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন ২২ জন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত পাঁচ বছরে ৪০১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আইনটি বাতিল হলেও এই আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো চলমান আছে; যদিও এর ৯৮ শতাংশই ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক।
আইনি বিধিনিষেধের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়ার ঘটনাও তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত করেছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর এমনকি জনগণের জন্য উন্মুক্ত প্রতিষ্ঠানে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে একটা ভয়ের পরিবেশ চলছে।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন এলে নীতিনির্ধারকেরা কতটি সংবাদপত্র, নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশন দেশে আছে, সেই হিসাব দেন। কিন্তু তঁাদের মনে রাখা উচিত সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা দিয়ে এর স্বাধীনতা নিরূপণ করা যায় না। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে আরও যে বিষয় জড়িত যথা গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, বাক্স্বাধীনতার সূচকেও আমাদের অবস্থান ভালো নয়। সবাই সামনে এগোয়, অথচ আমরা প্রায় সব সূচকে পিছিয়ে যাচ্ছি।
যেকোনো দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে নেতিবাচক ফল এলেই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হইচই করেন। এর যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন করেন। আরএসএফএর প্রতিবেদনের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আরএসএফএর সূচকে ভুল থাকলে সরকার সেটি তথ্য–উপাত্ত দিয়ে বলুক। ঢালাওভাবে ভুল তথ্য ও অপতথ্য বলার সুযোগ নেই।
আর বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা যে ক্রমেই খর্ব হচ্ছে, সেটা প্রমাণ করতে আরএসএফএর সূচকের প্রয়োজন হয় না। এখানকার সংবাদমাধ্যমের অংশীজনেরা নিজেদের অভিজ্ঞতায়ই সেটা প্রত্যক্ষ করছেন। সরকার যদি বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমকে উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার ও সিরিয়ার সমকক্ষ অবস্থানে নিয়ে যেতে না চায়, তাহলে আইনি, অবকাঠামো ও পরিবেশগত বাধাগুলো দূর করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেবে আশা করি। সেই সঙ্গে বাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে সাংবাদিক হয়রানি বন্ধ করার দাবি জানাই।