জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্র সংহত হোক

সম্পাদকীয়

স্বাগত ২০২৫। খ্রিষ্টীয় নতুন বছরের সূচনা হলো আজ। ২০২৪ সালেও বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে। সীমান্ত লঙ্ঘন করে লেবাননেও তারা হামলা চালিয়েছে। প্রায় তিন বছর ধরে চলে আসা রুশ–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হয়নি বৃহৎ শক্তিগুলোর একগুঁয়েমির কারণে। গণ–অভ্যুত্থানের মুখে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল–আসাদ পদত্যাগ করে রাশিয়ায় পালিয়ে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি বদলে দিতে পারে। শ্রীলঙ্কায় গণ–অভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে।

এদিকে ২০২৪ সালে আমাদের জাতীয় জীবনে যে অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে, তা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেমন বিরাট ভূমিকা রাখবে, তেমনি স্বৈরশাসকদের জন্যও বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে। আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮–এর ধারাবাহিকতায় জানুয়ারিতে আরেকটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার প্রয়াস নিয়েছিল, যা দেশবাসী মেনে নেয়নি। মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয় এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। অতীতের সব আন্দোলনে রাজনৈতিক দল নেতৃত্ব দিলেও এবারে আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল ছাত্রনেতৃত্ব। বিপুল জনতা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে গণ–অভ্যুত্থানকে সফল করে তোলে।

৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব নেয়। ভেঙে পড়া অর্থনীতি সচল রাখা ও জনজীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে পড়ে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন থেকে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নেওয়া। এই লক্ষ্যে তারা বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সরকারের কাছে যাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শুরু থেকেই জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আশা করা যায়, নতুন বছরে রাজনৈতিক দলসহ সমাজের অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কেবল নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও জাতীয় ঐকমত্য অপরিহার্য। এর সঙ্গে যেই প্রশ্নটি সামনে এসেছে, তা হলো জুলাই অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার ও স্বীকৃতি।

ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাদানুবাদ শুরু হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও কোথাও সংঘাতের খবরও পাওয়া যাচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক ধারাকে এগিয়ে নেওয়ার পথে প্রধান বাধা। রাজনীতিতে পথ ও মতের পার্থক্য থাকবে, কিন্তু সেই পার্থক্যকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান কিংবা সংঘাত কোনোভাবে কাম্য নয়।

২০২৪ সালে বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়েছে। আমরা আশা করতে চাই, ২০২৫ সাল হবে গণতন্ত্র উত্তরণের বছর, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে যার ইঙ্গিত রয়েছে। এই দেশে ধর্ম–জাতি কিংবা বর্ণের কারণে কেউ তার মানবিক ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। ২০২৫ সালের শেষ কিংবা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধ—যখনই নির্বাচন হোক না কেন, তা হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ ও ভয়ভীতিহীন। ২০২৪ সালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী ফিরে আসার খবর উদ্বেগজনক। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের অভিঘাত সীমান্তের এপারে এসে পড়লে তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বয়ে আনবে। কূটনৈতিকভাবে এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করতে হবে।

২০২৪ সালের জনজীবনের শান্তি ও স্বস্তি অনেকটা কেড়ে নিয়েছিল নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি। এ বিষয়ে সরকারের কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ প্রত্যাশিত। যে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এ দেশের মানুষ জীবন দিয়ে বিতাড়িত করেছে, সেই ব্যবস্থার যেন পুনরাগমন না ঘটতে পারে, সে বিষয়েও ছাত্রনেতৃত্ব, রাজনৈতিক দলসহ নাগরিকদের সজাগ থাকতে হবে। নতুন বছরে জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্র সংহত হোক।

২০২৫ সবার জন্য সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক। সবাইকে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।