সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যে ব্যাখ্যাই দিন না কেন, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অভিযোগ, আজিজ আহমেদ ব্যক্তিস্বার্থের বিনিময়ে সরকারি নিয়োগের ব্যবস্থা, সামরিক বাহিনীর ঠিকাদারি অবৈধভাবে পাইয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে যোগসাজশ ও ভাইয়ের অপরাধ সত্ত্বেও তাঁকে বাঁচাতে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক সেনাপ্রধান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো কোনো কাজ তিনি করেননি।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে মোহাম্মদ হাসান নামে ২০১৪ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়েছিলেন সাবেক সেনাপ্রধানের এক ভাই হারিছ আহমেদ। তিনি ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট এনআইডিতে নিজের ছবি পরিবর্তন করেন, যার সুপারিশ করেছিলেন আজিজ আহমেদ। কারও নামে ভুয়া পরিচয়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করা যে ফৌজদারি অপরাধ, সেটা সাবেক সেনাপ্রধানের না জানার কথা নয়।
জমির দলিলসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাগজপত্রের জন্য ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরিতে তিনজন সেনা কর্মকর্তার ‘সুপারিশ’ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উল্লিখিত তিনজনের মধ্যে একজন প্রথম আলোর কাছে বলেছেন, তিনি এ ধরনের কোনো সুপারিশ করেননি। আরেকজন বলেছেন, একটি দলিলে থাকা সই তাঁর সইয়ের কাছাকাছি। কিন্তু এটি তাঁর সই নয়।
দেশের একাধিক থানা ও আদালতের নথিপত্র, সাজা মওকুফ চেয়ে (আজিজের আরেক ভাই তোফায়েল আহমেদ জোসেফের জন্য) মায়ের করা আবেদনসহ সাজা মওকুফের সরকারি প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, হারিছের বাবার নাম রয়েছে আবদুল ওয়াদুদ ও মায়ের নাম রেনুজা বেগম। কিন্তু হারিছ যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছেন, তাতে বাবার নাম সুলেমান সরকার এবং মায়ের নাম রাহেলা বেগম উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত (প্রথমে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল) জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পান।
২০২১ সালে আল-জাজিরায় প্রচারিত একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে, মোহাম্মদ হাসান নামে হারিছ একটি দলিল করেছিলেন ২০১৪ সালে। এটি সত্যায়ন করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে সাক্ষী হিসেবে নাম আছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কে বাশারের। তাঁর ঠিকানা লেখা আছে বিজিবি, পিলখানা। মেজর মো. সুজাউল হক নামের আরেকজনের নাম আছে সাক্ষী হিসেবে।
আজিজ আহমেদ ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক ছিলেন এবং ২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এতে স্পষ্ট যে তিনি ক্ষমতাকাঠামো ব্যবহার করেই ভাইকে ভুয়া আইডি নিতে সহায়তা করেছেন। সাবেক সেনাপ্রধান ক্ষমতাকাঠামোর ভেতর থেকে যেসব অন্যায় করেছেন, সেটা সংশ্লিষ্টদের না জানার কথা নয়। তিনি যদি ভাইয়ের নামে ভুয়া আইডি তৈরিতে সহায়তা করে থাকেন, সরকার কেন ব্যবস্থা নেবে না? নির্বাচন কমিশনই–বা কেন ভুয়া আইডির বিষয়টি জানার পর বাতিল করবে না।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলেছে, তাদের এখতিয়ারভুক্ত হলে আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করে দেখবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন, যাদের দায়িত্ব পরিচয়পত্র দেওয়া, তারা যখন দেখল সাবেক সেনাপ্রধানের ভাই ভুয়া নাম-পরিচয় দিয়ে আইডি নিয়েছেন, সেটা কেন বাতিল করবে না। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে তথ্য প্রকাশের পরও তদন্ত না করা অমার্জনীয় বলে মনে করি। আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে, তার বেশির ভাগই ফৌজদারি অপরাধ-সংশ্লিষ্ট। অতএব এ ক্ষেত্রে সেনা আইনের দোহাই দেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। ফৌজদারি অপরাধের বিচার ফৌজদারি আইনেই হতে পারে।