ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় কতজন মারা গেছেন, তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায় হাসপাতাল ও থানা-পুলিশের মাধ্যমে। যদি কেউ হাসপাতালে ভর্তি না হন, থানায়ও তথ্য না জানান, সেটা হিসাবের বাইরেই থেকে যাবে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। কিন্তু যে পরিসংখ্যান আমরা নিয়মিত পাই, সেটি আমাদের শঙ্কিত করে তোলে।
সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলো আমাদের কমবেশি সবারই জানা, যেমন—সড়ক অব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত বা ত্রুটিপূর্ণ সড়ক এবং চালকের বেপরোয়া যান চালনা। এবারও ঈদের আগে ও পরের সময়টাতে সড়কে একের পর এক মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে প্রচলিত কারণগুলোই, যেসবের কার্যকর সমাধান আমরা আসলে সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে করতে পারছি না।
এবারের ঈদে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চুনতি জাঙ্গালিয়া বাঁকে। বুধবার সকালে রিলাক্স পরিবহনের দ্রুতগতির যাত্রীবাহী একটি বাস সেখানে এলে চালক হার্ড ব্রেক করতে গেলে বাসটির সামনের অংশ ঘুরে যায়। এতে বাসটি মহাসড়কে আড়াআড়ি হয়ে যায়। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা কক্সবাজারগামী দ্রুতগতির একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে বাসটির সংঘর্ষ হয়। মুহূর্তেই কক্সবাজারগামী দ্রুতগতির আরেকটি মাইক্রোবাস দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে শিশু, নারীসহ ১০ জন মারা যান। একই স্থানে সোমবার সকাল সোয়া সাতটার দিকে যাত্রীবাহী বাস ও মিনিবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ তরুণ নিহত হন বলে জানা যায়।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এসব মৃত্যু কি এড়ানো যেত না? সড়কের ওই বাঁক যে যানবাহনের জন্য একটি বিপজ্জনক, সেটা নিশ্চয়ই সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অজানা নয়। তারপরও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? এই বাঁকে আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কেবল ঢাকা–চট্টগ্রাম সড়ক নয়, দেশের আরও অনেক সড়কে এ রকম বিপজ্জনক বাঁক আছে। বহু বছর আগে ঢাকা-মানিকগঞ্জ সড়কে এ রকম একটি বিপজ্জনক বাঁকে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিকতার শিক্ষক মিশুক মুনীর নিহত হলে দেশব্যাপী প্রতিবাদ হয়। পরে সরকার বিপজ্জনক বাঁকটি সংস্কারও করে। কিন্তু চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের বাঁকটির মতো আরও অনেক বাঁক বিপজ্জনক অবস্থায়ই থেকে গেছে।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন ও পরের দুই দিনে বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় আরও মানুষ নিহত হয়েছেন। এর বড় অংশ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। কোনোটি চালকের বেপরোয়া চালনার জন্য, কোনোটি অপর বাহনের ধাক্কায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে। ঈদের সময় গ্রামগঞ্জে বা মফস্সলে অতিরিক্ত আরোহী নিয়ে মোটরসাইকেল চালনা বেড়ে যায়। এমনকি খুব কম চালক ও আরোহীদের মাথায় থাকে হেলমেট।
ঈদের আগে দুর্ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে। ঈদযাত্রায় কর্তৃপক্ষ যতটা সতর্ক থাকে, পরে আর থাকে না, একটা ঢিলেঢালা ভাব চলে আসে। এটাও দুর্ঘটনার বড় কারণ। একটি দুর্ঘটনা মানে একটি পরিবারের কান্না। দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে বা পঙ্গু হয়ে গেলে সেটা সেই পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি, স্বজনদের সারা জীবন বহন করতে হয়। আহত ব্যক্তিরাও একসময় নিজের কাছে, এমনকি পরিবারের কাছেও বোঝা হয়ে যান।
সড়কে কেউ বেপরোয়া যান চালালে আমরা চালককে দোষারোপ করি, কিন্তু আঁকাবাঁকা সড়কের কারণে যেসব দুর্ঘটনা হয়, সেই দায় সড়ক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে। রাতারাতি সড়কগুলোর বাঁক মেরামত করা না গেলেও তারা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। সেখানে নিয়মিত মনিটরিং, জরুরি সংকেত ও গতি নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকলেও দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আশা করি, বিলম্বে হলেও কর্তৃপক্ষ সজাগ হবে।