গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের সঙ্গে নিয়োজিত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন ঘিরে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা একদিকে যেমন অনভিপ্রেত; অন্যদিকে গভীর উদ্বেগেরও। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি দেশের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থায় বিরাট একটা সংস্থা, মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের ৫৫ শতাংশ এই সংস্থার অধীন। চাকরির নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি থাকতেই পারে, সেই দাবি ন্যায্য ও যৌক্তিকও হতে পারে; কিন্তু তা আদায়ের জন্য বিদ্যুতের মতো একটি জরুরি সেবার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি একীভূতকরণ এবং অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়নসহ চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিত কর্মচারীদের স্থায়ী নিয়োগের দাবিতে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন সমিতির প্রায় ৪৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। গত বৃহস্পতিবার আরইবি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ২০ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে এবং ১৫ জনকে আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা দেয়। এরপর কয়েকজন কর্মকর্তাকে রিমান্ডে পাঠান আদালত।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেন সমিতির কর্মচারীরা। দেশের ৮০টির মধ্যে ৬০টি সমিতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে বিপুলসংখ্যক গ্রাহক কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিলেন। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর সঙ্গে আলোচনা শেষে আন্দোলনকারীরা আন্দোলন স্থগিত করেন।
এটা স্পষ্ট যে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ বছরের শুরু থেকে আন্দোলন করে আসছেন। বিগত সরকারের আমলে বিদ্যুৎ বিভাগ দাবিদাওয়া পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি করে। কিন্তু সেই কমিটি কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সমিতি আন্দোলন অব্যাহত রাখে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা–কর্মচারীরা বঞ্চিত বোধ করলে তাঁদের দাবিদাওয়া তাঁরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু এর বদলে হুমকি-ধমকি কিংবা অসহিষ্ণু আচরণ দাবি আদায়ের পথ হতে পারে না। বিদ্যুৎ একটি জরুরি সেবা এবং এ-সংক্রান্ত স্থাপনাগুলো কি–পয়েন্ট ইনস্টলেশনের (কেপিআই) আওতায় পড়ে। ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড।
আরইবির পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কিছু বিপথগামী কর্মকর্তা-কর্মচারী বিদ্যুৎ খাতকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছেন। গত সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালীদের মদদে বিদ্যুৎ কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এ অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে সেটা গুরুতর ঘটনা। যদি কেউ এ রকম অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে সেটা সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবে ঢালাও মামলা ও ইচ্ছেমতো আসামি করা হলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না।
আমরা মনে করি, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দাবির যৌক্তিকতা থাকলে পদ্ধতিগতভাবে ও আইনানুগ প্রক্রিয়ায় সেটা সমাধান করতে হবে। এখানে জোরাজুরি করে দাবি আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। জনগণকে জিম্মি করা হলে যৌক্তিক দাবির আন্দোলনও অনেক সময় অসাড় হতে বাধ্য।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলনকারীরা ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে দাবি আদায়ের কথা বলেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলনকারীদের প্রতি তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনার জন্য সময় চেয়েছে। আমরা মনে করি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানই সেরা পথ। কিন্তু জবরদস্তি করে কেউ যদি দাবি আদায় করতে চান, তাহলে তাঁদের অনৈতিক চাপের মুখে নতি স্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।