অভিযুক্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন

সম্পাদকীয়

আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের নামে যেভাবে গয়রহ মামলা হচ্ছে, তা ন্যায়বিচারের সহায়ক, না পরিপন্থী—এই প্রশ্ন উঠেছে। বিচারের ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই সুযোগ অনেকেই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ আছে।

আইনজীবীরা বিচারপ্রক্রিয়ার অপরিহার্য অংশ। মামলার বাদী বা বিবাদীর পক্ষে তাঁরাই অবস্থান নিয়ে থাকেন। কিন্তু বেশ কয়েকটি মামলায় আইনজীবীদের একাংশ এমন ভূমিকা পালন করেছেন যে বিবাদীপক্ষে কেউ দাঁড়াতে পারছেন না। এটি অত্যন্ত নিন্দনীয়।

কয়েক দিন আগে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি আদালত প্রাঙ্গণে লাঞ্ছিত হয়েছেন। একজন নারী হিসেবেও তাঁর যে মর্যাদা ও সুরক্ষা পাওয়ার কথা, সেটি দিতে সংশ্লিষ্টরা ব্যর্থ হয়েছেন। এর আগে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও যে ধরনের আচরণ করা হয়েছে, তা-ও অনাকাঙ্ক্ষিত।

তাঁদের পক্ষে যেসব আইনজীবী দাঁড়াতে চেয়েছেন, তাঁরাও প্রতিপক্ষের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। যদিও তাঁরাও আইনজীবী। বিচারাঙ্গনে যদি এ রকম নিন্দনীয় ঘটনা ঘটে, তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে কী করে।

গত শনিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক শামসুদ্দীন আহমদ ওরফে মানিক বেধড়ক মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন সিলেটের আদালতে তোলার সময়। মারধরে তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন এমনকি অস্ত্রোপচারও করতে হয়েছে। কোনো আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। সেই দায়িত্ব পালনে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।

আদালত প্রাঙ্গণে এসব অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য একশ্রেণির আইনজীবীই দায়ী। আইনজীবীরা যে শপথ নিয়ে এই পেশায় এসেছেন, সেটা বিস্মৃত হতে পারেন না। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি অপরাধ করে থাকেন, তাহলে সেটি আদালতেই প্রমাণিত হবে এবং আইনানুযায়ী শাস্তি পাবেন। কিন্তু আইনজীবী হয়ে আদালতে তাঁরা কাউকে মব ট্রায়াল কিংবা জনহেনস্তা করতে পারেন না।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাংবাদিক–আইনজীবী মইনুল হোসেনসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি আদালত প্রাঙ্গণে জনহেনস্তার শিকার হয়েছেন। এটা ছিল অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি ওই সরকারের বিদ্বেষমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ। দেশের ভেতরে ও বাইরে এ নিয়ে প্রতিবাদও হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সরকারের পতন ঘটানোর পরও সেই ধারা বজায় থাকা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, এসব মামলা যে–ই দায়ের করুন না কেন, অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা হয়েছে। পরে যাঁকেই গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁদের এক বা একাধিক মামলার আসামি দেখানো হয়, রিমান্ডেও নেওয়া হয়। এটি পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলার ধারাবাহিকতা ছাড়া কিছু নয়।

সাবেক আইনমন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ও রিমান্ডে নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তাঁদের হত্যার ‘উসকানিদাতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আদালতের আচরণে তেমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বিগত সরকারের আমলে ন্যায়বিচার ছিল না। পুলিশ ও আদালতকে রাজনৈতিক স্বার্থে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হতো। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রাখার সুযোগ নেই। আমরা মনে করি, অজ্ঞাতনামা আসামির সঙ্গে নতুন নতুন নাম জুড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। মামলা হতে হবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে।