নীতি–সহায়তা ও আর্থিক খাতে সুশাসন জরুরি

সম্পাদকীয়

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী সম্মেলনে দেশের অর্থনীতি তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এই সম্মেলনে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা যেসব কথা বলেছেন, তা নতুন নয়। কেবল পুরোনো সমস্যাগুলোর কথা তাঁরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

সম্মেলনের শেষ দিনে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর নগদ সহায়তা বা ভর্তুকির পরিবর্তে ব্যবসার খরচ কমানোর জন্য সরকারের কাছে যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।

‘বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণের চ্যালেঞ্জ ও কাঠামোগত রূপান্তর’ শীর্ষক অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন পরিষেবায় খরচ বেড়েছে ৪০০ শতাংশ এবং ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে হয়েছে ১৩ শতাংশ। পণ্য পরিবহনে খরচ কিলোমিটারপ্রতি বিশ্বে প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যবসার এই খরচ কমাতে না পারলে আমরা সামনের দিনে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব না। ফলে আমাদের প্রণোদনা কিংবা ভর্তুকির দরকার নেই, ব্যবসার খরচ কমান।’

সরকার রপ্তানিমুখী পণ্যের বিপরীতে ব্যবসায়ীদের কিছু প্রণোদনা দিয়ে থাকে; সাম্প্রতিককালে তা–ও কমে গেছে। কিন্তু ব্যবসার বর্ধিত খরচ যদি প্রণোদনাকে ছাড়িয়ে যায়, ব্যবসায়ীরা কোনোভাবে লাভবান হবেন না। অতীতে আমরা দেখেছি, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমলেও দেশীয় বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে সরকার মুনাফা করেছে। এটা যেমন অযৌক্তিক, তেমনি সরকার যে নিজেকে ব্যবসাবান্ধব বলে দাবি করে, তারও পরিপন্থী। জ্বালানির দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ ও পরিবহন ব্যয়—উভয়ই বাড়ে। যার দায় শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপরই পড়ে।

সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর যথার্থই বলেছেন, ওয়ালমার্ট, নাইকিসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় যেসব ব্র্যান্ড চীন থেকে তাদের পণ্য উৎপাদন অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, সেসব ব্র্যান্ড যাতে বাংলাদেশে আসে, সেই অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘ডুইং বিজনেস ইনডেক্স’ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম, পূর্ববর্তী বছরে যা ছিল ১৭৬তম। এই অগ্রগতি সত্ত্বেও আমরা ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। সরকার দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুললেও সেখানে অবকাঠামোগত ও পরিষেবাগত সুবিধা এখনো অপর্যাপ্ত।

মূল প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান প্রশ্ন রেখেছেন, ‘গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম কাছাকাছি অবস্থান করলেও বর্তমানে আমরা পিছিয়ে পড়লাম কেন?’ ভিয়েতনামসহ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো ব্যবসার ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কার করেছে। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা সংস্কারের কথা বললেও অগ্রগতি খুবই কম।

আমাদের মনে রাখতে হবে, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে অবশ্যই ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সরকারকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে।

 নাসিম মঞ্জুর ব্যাংকঋণের সুদের হার বেশি হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ব্যাংকঋণের সুদের হার তখনই কমানো সম্ভব, যখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে যাবে। একশ্রেণির ব্যবসায়ী রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকিং খাত থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে দিয়েছেন, সেদিকে সরকারের খুব নজর ছিল বলে মনে হয় না।

সরকারের নীতি–সহায়তা কৌশলের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হলে ব্যবসার খরচ এমনিতেই কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য সরকারের আলাদা প্রণোদনা দেওয়ারও প্রয়োজন হবে না। তবে সবার আগে যেটি প্রয়োজন, তা হলো আর্থিক খাতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।