উপদেষ্টার নির্দেশ পালিত হবে কি

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনার সর্বত্র যে দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনা চলছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সরকার আসে–যায়, কর্মকর্তারা–পদাধিকারীরা বদল হন; কিন্তু সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিএর (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) কর্মসংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন নেই। বছরের পর বছর সড়কে হাজার হাজার ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে, লাখ লাখ চালক গাড়ি চালাচ্ছেন লাইসেন্স বা ছাড়পত্র ছাড়া। আবার চালকদের লাইসেন্স নবায়ন করতেও সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

দেশের অন্যান্য এলাকা তো বটেই, রাজধানী ঢাকা শহরে প্রচুর পরিমাণ ফিটনেসবিহীন বা লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি চলাচল করে। এটা নিয়ে নানা উদ্যোগ, আয়োজন, আইন–বিধি জারি সত্ত্বেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানটি নিজেই। যাদের ফিটনেসহিবহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করার কথা, সেই বিআরটিএ সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ ভবনে ‘সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক সভায় সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বিআরটিএ কর্মকর্তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগামী এক মাসের মধ্যে সেবায় উন্নতি করতে না পারলে বিআরটিএর চেয়ারম্যানসহ সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সভা শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় যেন চলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে এবং ফিটনেস দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বেসরকারি খাতের সহায়তা নিতে হবে।’ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকার যানজট পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতির ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে যানজটপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে দুই দিনের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশকে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে। রাস্তার মধ্যে কোনো গাড়ি অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে যানজট হলে, সেই গাড়িকে জরিমানার বদলে আটক করারও নির্দেশ দিয়েছেন উপদেষ্টা।

ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে নামিয়ে মালিক ও চালকেরা কেবল পরিবেশ দূষণ করছেন না, যাত্রী সাধারণকেও দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। সাধারণত একটি গাড়ি ২০ বছর পর সড়কে চলাচলের অযোগ্য হয়। উপদেষ্টা আগামী বছর মে মাসের মধ্যে ২০ বছরের পুরোনো বাস ঢাকা থেকে তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। তবে ঢাকা থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ যান তুলে নিলেই তো হবে না। সারা দেশেই এই বিধান কার্যকর করতে হবে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা যখন বিআরটিএ কর্মকর্তাদের এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন, তখন সড়ক পরিবহনের বাস্তব চিত্রটা কী। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশে পাঁচ লাখের বেশি ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করে। এসব বিষয় বিআরটিএর অজানা নয়। তারপরও যানবাহনগুলো কীভাবে চলাচল করে? তারা কেন মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনগুলো জব্দ করে না? এর পেছনে মোটা অঙ্কের অবৈধ লেনদেন আছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। বিআরটিএর এক সমীকরণে দেখা যায়, প্রতিবছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে, যা দেশের মোট জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। ফিটনেস নেই ৩৩ শতাংশ বাসের এবং ৫৬ শতাংশের নেই স্পিড গভর্নরের সিল।

উপদেষ্টার কঠোর হুঁশিয়ারির পর বিআরটিএর কর্তাব্যক্তিরা কী করেন, সেটাই দেখার বিষয়। তাঁরা যদি আগের মতো গদাই লশকরি কায়দায় চলেন, অনিয়ম ও অব্যবস্থা দেখেও না দেখার ভান করেন, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আর যদি সত্যি সত্যি তাঁরা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সড়কে যেমন শৃঙ্খলা ফিরবে, তেমনি ফিটনেসবিহীন যানের দুর্গতি ও ঝুঁকি থেকেও দেশবাসী রেহাই পাবেন।