বর্তমান সরকারের শেষ অর্থবছরে (২০২৩-২০২৪) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন, তার আকার আগের অর্থবছরের তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে আয়ের প্রাক্কলন হচ্ছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর অর্থ ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ঘাটতির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী এমন সময় বাজেটটি পেশ করলেন, যখন অর্থনীতিতে কোথাও কোনো সুখবর নেই। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অন্যদিকে ডলার-সংকটের কারণে আমদানি হুমকির মুখে। অথচ ডলারের সংস্থান কিংবা মুদ্রাস্ফীতি কমানোর কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। বাজেটে বড় ব্যয়ের পরিকল্পনা থাকলেও কীভাবে আয় বাড়ানো যাবে, তারও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা পেশ করতে পারেননি তিনি।
তবে প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ আছে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যক্তি করসীমা বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং কিছু বিলাসী পণ্যের আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা। আমদানি পণ্যে ব্যাপকভাবে সম্পূরক শুল্ক আরোপ, জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ব্যয় বৃদ্ধি, দ্বিতীয় গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে কর আরোপে স্বল্প আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। কিন্তু সরকারি সেবা পেতে প্রত্যেক নাগরিককে দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর দেওয়ার বিধান কতটা যৌক্তিক হয়েছে, তা ভেবে দেখা দরকার। একজন দিনমজুরেরও সরকারি সেবা নিতে হয়। তাঁকেও কি দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে?
অর্থমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু বাজেটে কোনো প্রতিফলন নেই। এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছিলেন। ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। বাস্তবতা হলো দেশে শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে। এবারের বাজেটেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো পথনির্দেশ আছে বলে মনে হয় না। অর্থমন্ত্রী বেসরকারি বিনিয়োগ ২৭ শতাংশে উন্নীত করার যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা-ও বাস্তবসম্মত নয় বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন।
যেকোনো দেশের মানবসম্পদ তৈরির জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ানো জরুরি। এবারও এই দুটি খাত অবহেলিত থেকে গেছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকটের কালে যেখানে কৃচ্ছ্রসাধন জরুরি ছিল, সেখানে সরকারের পরিচালনা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৭ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর কথা বলেছেন। এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু তিনি এই স্কিম চালু হলে টাকা রাখার জায়গা থাকবে না বলে যে মন্তব্য করেছেন, সেটা হাস্যকর বলেই মনে হয়। গত বছরের বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ সাড়ে ৭ শতাংশ জরিমানা দিয়ে ফেরত আনার কথাও বলেছিলেন তিনি। একটি পয়সাও আসেনি।
অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটকে গরিববান্ধব বলে দাবি করেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতির দিকে থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়ানো তাঁর সেই ঘোষণার সমার্থক নয়। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপরই বেশি চাপ পড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির রাশ টানাও সম্ভব হবে না। কেননা, বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষকে যেন এই আক্ষেপ করতে না হয় যে ‘যা চেয়েছি তা-ও থাক, যা পেয়েছি, তা-ও। তুচ্ছেবলে যা চাইনি, তাই মোরে দাও।’