ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ দমনের উদ্দেশ্য নিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার কথা বলা হলেও এতে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আবার ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থেও আইনটির চরম অপব্যবহার হচ্ছে।
সেন্টার ফর গভর্নরস স্টাডিজের (সিজিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ আইনে ১ হাজার ১০৯টি মামলা হয়েছে, যাতে আসামি হয়েছেন ২ হাজার ৮৮৯ জন। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। নিষ্পত্তি হওয়া ২ শতাংশ মামলায় কেউ দণ্ডিত, কেউ খালাস পেয়েছেন। কিন্তু যেসব মামলার তদন্ত ঝুলে আছে, সেসব মামলার অভিযুক্তরা দীর্ঘদিন ধরে হয়রানি ও নির্যাতন ভোগ করছেন।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের আগে দায়ের করা ৭২৫টি মামলা এখনো তদন্তাধীন। আইনে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করা এবং প্রয়োজনে আরও ১৫ দিন বাড়ানোর বিধান আছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে। অভিযুক্তদের কেউ কেউ জামিনে মুক্তি পেলেও বাকিদের কারাগারেই থাকতে হয়। এই আইনের বেশির ভাগ ধারা অজামিনযোগ্য। এ আইনে আটক লেখক মোশতাক আহমেদ অসুস্থ অবস্থায় কারাগারেই মারা যান।
দেশের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন মহল থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হলেও সরকার বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না। এই আইনের অপব্যবহার ও বাড়াবাড়ি হয়েছে বলে খোদ আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও স্বীকার করেছেন। তিনি আইনের অপব্যবহার বন্ধের কথা বললেও বাস্তবে পরিস্থিতির ইতরবিশেষ ঘটেনি।
সাংবাদিকেরা শুরু থেকে আইনটির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এই আইনে যেসব ধারা আছে, তাতে স্বাধীন সাংবাদিকতা করা কেবল দুরূহ নয়, অসম্ভব। এতে বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার করতে পারবে। এ ছাড়া আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করায় কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয় বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক আইনটি সংশোধনীর তাগিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক সহিংসতা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পাইকারি হারে গ্রেপ্তার ও মানবাধিকারকর্মীদের হয়রানিতেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সাতটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের দপ্তর থেকে একটি চিঠি (টেকনিক্যাল নোট) দেওয়া হয়েছে। এটি সরকার পর্যালোচনা করে দেখছে। একই বিষয় নিয়ে ১৪ মার্চ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হওয়ার কথা আছে।
আমরা মনে করি, আইনটি সংশোধন বা পরিমার্জন সমস্যার সমাধান দেবে না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপব্যবহার হবে না বলে মন্ত্রীদের আশ্বাসও কোনো কাজে লাগবে না। যদি সরকার গণতান্ত্রিক শাসন, ভিন্নমত তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হয়, তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।