একজন চালক টানা কত ঘণ্টা গাড়ি চালাবেন 

সম্পাদকীয়

একজন চালকের পক্ষে টানা কত ঘণ্টা গাড়ি চালানো সম্ভব? প্রচলিত মোটরযান আইনে বলা আছে, টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি একজন চালক যানবাহন চালাতে পারবেন না আর বিশ্রাম নিয়ে দিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা গাড়ি চালাতে পারবেন। অথচ টানা ২৬ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স চালানোয় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা আমরা দেখতে পেলাম। 

বাংলাদেশে যে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, তার অন্যতম কারণ চালকদের জন্য নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। রাজধানী ঢাকার চালকেরা ফজরের আজানের পর শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে থাকেন। আন্তজেলায় চলাচলকারী ট্রাকগুলো অনেক সময় দু-তিন দিন টানা রাস্তায় থাকে। দূরপাল্লার বাসগুলোয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাওয়া-আসার পুরোটা পথে একজন চালকই থাকেন। ফলে চালকেরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন, দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। চালকদের কর্মঘণ্টা নিয়ে প্রচলিত আইন মানার তোয়াক্কা পরিবহনমালিকেরা করেন না। সড়ক-মহাসড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে চলেছে। ফলে দুর্ঘটনায় মানবিক ও পারিবারিক বিপর্যয় থামানো যাচ্ছে না।

১৮ জানুয়ারি প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স পেছন থেকে একটি চলন্ত ট্রাককে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে অ্যাম্বুলেন্সের একটি অংশ ট্রাকের নিচে ঢুকে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, বেপরোয়া গতির পাশাপাশি টানা ২৬ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স চালানোয় ক্লান্ত ছিলেন চালক। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাপ্রবাসী কম্পিউটার প্রকৌশলী লুৎফুন্নাহার লিমা তাঁর অসুস্থ মাকে বরিশাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনায় মা ও মেয়ে, চালক ও তাঁর সহকারীসহ অ্যাম্বুলেন্সে থাকা সবাই নিহত হন। 

নিহত চালক রবিউল ইসলামের স্বজনদের বরাতে পুলিশ জানিয়েছে, আগের দিন রাতে ঢাকা থেকে রোগী নিয়ে ভোলায় যান। পরদিন রাতে বরিশাল থেকে রোগী নিয়ে ফেরার পথে দুর্ঘটনার মুখে পড়েন। দুর্ঘটনাকবলিত অ্যাম্বুলেন্সের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁর একটি অ্যাম্বুলেন্সই রয়েছে এবং সেটি চালানোর জন্য একজন চালককেই তিনি নিয়োগ দেন। প্রশ্ন হলো, রোগী আনা-নেওয়ার মতো কাজে অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনার ক্ষেত্রে নিবন্ধন কোন প্রক্রিয়ায় দেওয়া হয়? অংশীজনদের বারবার তাগিদ সত্ত্বেও কোন যুক্তিতে অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি।

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিশু-কিশোরদের আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে পাঁচ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়, তাতে সুস্পষ্টভাবে চালকের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্যে রাখা হয়। এর মধ্যে দূরপাল্লার পথে বিকল্প চালক রাখা, যাতে একজন চালককে টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি যানবাহন না চালাতে হয় এবং নির্দিষ্ট দূরত্বে সার্ভিস সেন্টার বা চালকদের জন্য বিশ্রামাগার করার নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু চার বছরের বেশি সময় পার হলেও সেই নির্দেশনার কোনোটিই বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি। সড়কে উল্টো বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য বেড়েছে। ফলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে। রেড সেফটি ফাউন্ডেশন ও যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২২ সালে সড়ক ছিল গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী।

দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধ করতে গেলে সড়কে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। যানবাহনের স্টিয়ারিংয়ের সঙ্গে যাত্রী ও পথচারীর জানমালের নিরাপত্তার অনেকটাই চালকের ওপর নির্ভরশীল। বাড়তি মুনাফার আশায় অমানবিক ও অযৌক্তিকভাবে চালকের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কারও জন্যই হিতকর নয়। এভাবে আর কত প্রাণহানি হবে? চালকদের জন্য টানা পাঁচ ঘণ্টা ও দিনে আট ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানোর বিধি বাস্তবায়ন করতে হবে।