অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে শহরগুলো এখন কংক্রিটের জঙ্গল। সেখানে পদে পদে মৃত্যুফাঁদ। কে কখন সেই ফাঁদে আটকে পড়ে, কেউ জানে না। তবে এটি নিশ্চিত, সমাজের ওপরতলার মানুষ, যাঁরা রাষ্ট্রের সবচেয়ে সুবিধাভোগী এবং ক্ষমতাচর্চার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, তাঁরা সেই ফাঁদ সহজে এড়িয়ে চলতে পারেন। ক্ষমতাচর্চায় পিষ্ট বা ক্ষমতাহীন মানুষ সেখান থেকে বাঁচতে পারেন না। এটিই আমাদের শহরগুলোর বাস্তবতা। চট্টগ্রাম শহরে সুরক্ষাবিহীন ভবন নির্মাণ এখন এমন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর চট্টগ্রামে নির্মাণকাজ চলার সময় অন্তত ৩৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কারণ, কোনো ভবন নির্মাণ ও পুরোনো ভবন ভাঙার সময় যে সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি নেওয়া হচ্ছে না। এতে নির্মাণশ্রমিকদের জীবন যেমন বিপন্ন হয়ে পড়েছে, তেমনি পথচারীসহ প্রতিবেশীরাও ঝুঁকিতে পড়ছেন। তবে শ্রমিকেরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন বেশি।
সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নগরীর বাকলিয়ার কল্পলোক আবাসিক এলাকায় তিন নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ দেশে শ্রমিকের মৃত্যুই সবচেয়ে বেশি সস্তা। অথচ দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের শিকার হতে হচ্ছে শ্রমিককে বা যেকোনো মানুষকে, তা বেশির ভাগই প্রতিরোধযোগ্য।
নগর-পরিকল্পনাবিদেরা মনে করছেন, এসব দুর্ঘটনার জন্য তদারক সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ভূমিকা কম দায়ী নয়। আবার সিডিএর বক্তব্য হচ্ছে, নগরে শত শত ভবনের নির্মাণকাজ চলে। জনবল-সংকটের কারণে সার্বক্ষণিক তদারক করা সম্ভব হয় না। তবে ভবনমালিক ও ভবন নির্মাণে যুক্ত ব্যক্তিরা নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে সচেতন হলে নির্মাণজনিত দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। তবে স্থানীয় অনেক বাসিন্দার ভাষ্য, প্রতিটি ভবনের নকশা অনুমোদন পাস করা থেকে শুরু করে নির্মাণ পর্যন্ত বিপুল অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। সিডিএতে এটি এখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট অনেকের প্রশ্ন, প্রতিটি ভবন ঘুরে টাকা নিয়ে যান এমন লোকজনও আছেন সিডিএতে, তাহলে ভবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তাদের জনবলের অভাব হবে কেন? তার মানে এসব মৃত্যুর জন্য সিডিএর অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এখানে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনেরও দায় আছে। প্রতিটি ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর জন্য মামলা ও তদন্ত হওয়ার কথা। সেসব ঠিকঠাক হয় কি না, তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। ঘটনার জন্য দায়ী আসামিকে গ্রেপ্তার বা সাজা হয় না বললেই চলে। ফলে কোনো বাড়ির মালিক বা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ভবন নির্মাণে শ্রমিকদের জন্য বা সামগ্রিকভাবে কোনো সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করাকে অপরিহার্য মনে করছে না। তাহলে কি এসব মৃত্যু বন্ধ হবে না?