বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। ঠিক একইভাবে এ খাতে অব্যবস্থাপনারও শেষ নেই। শিক্ষার নীতিনির্ধারকেরা নতুন নতুন নীতি ও পদ্ধতি প্রণয়নে যতটা আগ্রহী, সেটা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে সমান মনোযোগী নন।
নতুন বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রমের যাত্রা শুরু হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে শিখন ও মূল্যায়নের ধরন। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম যে শিক্ষকেরা বাস্তবায়ন করবেন, তাঁদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। অনলাইনে মাত্র এক ঘণ্টার বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে।
আগামী ১ জানুয়ারি প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২৪ সাল থেকে বাকি শ্রেণিগুলোতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। গত মে মাসে এই শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। এরপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে একটি পথরেখাও ঠিক করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
পথরেখা অনুযায়ী, সেখানে প্রতিটি জেলায় প্রতিটি বিষয়ের জন্য তিনজন করে মাস্টার ট্রেইনার বা মূল প্রশিক্ষক তৈরি করা হবে। প্রতিটি উপজেলায় তাঁরা তিনজন করে শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবেন। তাঁদের মাধ্যমে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশে সব শিক্ষককে সশরীর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, এ পর্যন্ত কেবল জেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুমোদন ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের পথরেখা কয়েক মাস আগে চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পরও সেটা বাস্তবায়ন না হওয়াটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এনসিটিবি শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করলেও শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি)।
অথচ শেষ মুহূর্তে এসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে শিক্ষকদের অনলাইনে প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত আসে। এ সম্পর্কে মাউশির বক্তব্য হলো, শিক্ষকদের ইতিমধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা সম্পর্কে জানানো হয়েছে। অনলাইনে বিষয়ভিত্তিক আধেয়র ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাঁচ দিন সশরীর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
আগের শিক্ষাক্রমের তুলনায় নতুন শিক্ষাক্রমে আমূল পরিবর্তন আসছে। নতুন নতুন বিষয় যেমন যুক্ত হচ্ছে, সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের পদ্ধতিতে বদল আসছে। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রচলিত পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে।
নতুন পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতি—দুই বিবেচনাতেই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা বড় চ্যালেঞ্জ বলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবিদেরা মনে করেন। শিক্ষকেরা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে কতটা উপযুক্ত, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে অনেকের মধ্যে। এ বাস্তবতায় যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের উপযুক্ত করে গড়ে তোলাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাস্তবায়নে মাউশি যে গুরুত্ব দেয়নি, তা নতুন বছরের আগে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করতে পারার ঘটনা থেকেই স্পষ্ট।
এর আগে ২০০৮ সালে দেশে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। মাউশির তথ্য থেকে এখন পর্যন্ত ৩৮ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন না।
এই যখন বাস্তবতা, তখন অনলাইনে এক ঘণ্টার প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠানো রীতিমতো ছেলেখেলা। শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিয়ে এ ছেলেখেলা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে না পারার দায় মাউশি কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।