কোনো পক্ষেরই শক্তি প্রদর্শন কাম্য নয়

সম্পাদকীয়

প্রজাতন্ত্রের প্রশাসন পরিচালিত হয় সরকারের নীতি-পরিকল্পনার ভিত্তিতে। কিন্তু যদি দেশে আইনানুগ সরকারই না থাকে, তাহলে প্রশাসনে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। গত দুই দিনে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে যা ঘটেছে, তাকে স্বাভাবিক বলা যায় না।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বদলে গেছে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের চেহারা। সচিবালয়ে পদ-পদোন্নতি থেকে ‘বঞ্চিত’ এক দল কর্মকর্তা-কর্মচারীর তৎপরতা দেখা গেছে। সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরি কক্ষে তাঁরা সভাও করেছেন। তাঁদের বক্তব্য হলো তাঁরা দীর্ঘদিন পদোন্নতি ও পদায়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এখন তাঁরা ন্যায্য অধিকার পেতে চান।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেকেই সচিবালয়ে এসেছেন ভয়-শঙ্কা নিয়ে। অনেকে আসেননি। ফলে কাজ হয়নি, বরং আতঙ্কের কারণে মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে আকস্মিকভাবে অফিস ছাড়েন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গতকাল বুধবার উপস্থিতি কিছুটা বাড়লেও দাপ্তরিক তেমন কাজ হয়নি। মন্ত্রী-সচিবেরা মন্ত্রণালয়ের করণীয় ঠিক করেন। মন্ত্রীদের অনুপস্থিতিতে সচিবদেরই মন্ত্রণালয়ের কাজ দেখভাল করার কথা। কিন্তু গত দুই দিনে অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গরহাজির থেকেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে গতকাল যা ঘটল, তা খুবই উদ্বেগজনক। পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মচারীরা ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দাবি করেছেন। তা নিয়ে সেখানে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাঁদের দাবির মুখে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরসহ ছয়জন কর্মকর্তা পদত্যাগপত্র জমা দেন, যাঁরা বিগত সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। সচিবালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পদ-পদোন্নতি ও বৈষম্য নিয়ে বড় ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে।

এটা ঠিক যে দেশে এখন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। তবে খুব শিগগির একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। এই সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রেখে প্রয়োজনীয় কাজ করে যাওয়া প্রশাসনের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দায়িত্ব। তবে পুলিশ প্রশাসনে এরই মধ্যে কিছু পদ পরিবর্তন ও রদবদল হয়েছে। পুলিশে নতুন আইজিপি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুন সরকার নিশ্চয়ই বাকি কাজগুলো করবে, প্রয়োজনীয় রদবদল ও পদায়ন করবে। কিন্তু সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে পদবঞ্চিত হিসেবে বিবেচিতরা ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগে নানা তৎপরতা ও নিজেদের শক্তি প্রকাশের যে পথ নিয়েছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়।

গত ১৫ বছর প্রশাসনে নিয়োগ-পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে অনিয়ম হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। নিয়োগ–পদোন্নতির ক্ষেত্রে কাজ করেছে দলীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনা। যোগ্য ও মেধাবীরা নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত হয়েছেন। এই পরিস্থিতির নিশ্চয়ই অবসান জরুরি, কিন্তু তা হতে হবে যথাযথ নিয়ম বা প্রক্রিয়া মেনে। নিজেদের পদবঞ্চিত বিবেচনা করে কারও শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো কাজে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই। আমরা আশা করি প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ধৈর্য ধরে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন এবং তাদের নেওয়া পদক্ষেপের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখবেন।

জনপ্রশাসনে যে অস্থিরতা ও অচলাবস্থা চলছে, তার দ্রুত অবসান জরুরি। আমরা আশা করি নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এর আগপর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় থাকুক, কোনো পক্ষ থেকে শক্তি দেখানোর কোনো ঘটনা না ঘটুক, সেটাই প্রত্যাশিত।