কোনোভাবেই হাওরকে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না বলে অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী বলে মনে করি।
প্রশ্ন হলো, হাওরকে রক্ষা করা যাবে কীভাবে? সরকারের কোনো ঘোষণা বা নির্দেশনা এর জন্য যথেষ্ট নয়। হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে সেখানকার বাসিন্দাদের বিকল্প জীবিকার কথাও ভাবতে হবে। তাঁদের মৌলিক অধিকার তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার নিশ্চয়তাও। তাদের পেটে ভাত না দিয়ে পরিবেশ রক্ষার কথা বলা হবে হাস্যকর।
গত মঙ্গলবার সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘জাতীয় হাওর সংলাপ-২০২৪’–এ সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরাঞ্চলের কৃষক, জেলে এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে হাওর এলাকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
দেশের ৭ জেলায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে। এর আয়তন প্রায় ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর। হাওরাঞ্চলে ১৪৩ প্রজাতির দেশি মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ, কয়েক প্রজাতির মিঠাপানির চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রকার ছোট-বড় মাছ, শামুক, ঝিনুক রয়েছে।
সংলাপে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা হাওর এলাকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। হাওরের পানিপ্রবাহ, বাঁধ নির্মাণ দেখভালের দায়িত্ব পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। সেখানকার ধান ও অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ দেখভাল করে কৃষি মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের।
এই অবস্থায় হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজ করতে হবে সমন্বিতভাবে। হাওরে ইজারাপ্রথা চালু হওয়ার পর সেখানে যত্রতত্র বাঁধ নির্মিত হচ্ছে ধানের উৎপাদন বাড়াতে। এতে হাওরে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অনেক জেলে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। খেয়াল রাখতে হবে, হাওরে ধান চাষ করতে গিয়ে যেন মাছের উৎপাদন কমে না যায়। হাওরের পানিপ্রবাহ যথাসম্ভব অবাধ রাখতে হবে।
সংলাপে হাওর এলাকায় দেশি মাছের প্রজাতি রক্ষা ও প্রকৃত জেলেদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার জন্য ইজারাপ্রথা বাতিলেরও দাবি ওঠে এবং তাঁদের সঙ্গে উপদেষ্টাও সহমত প্রকাশ করেন। সম্মেলনে দেশি মাছের প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য হাওর এলাকায় মাছের অভয়ারণ্য করা এবং মা মাছের সুরক্ষার জন্য বৈশাখ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত তিন মাস হাওরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করার যে সুপারিশ এসেছে, তা বাস্তবায়ন করা কঠিন নয়।
হাওরবাসীর আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ ইটনা-মিঠামইন সড়ক; যেটি জনস্বার্থ, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ উপেক্ষা করে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবিশেষের ইচ্ছায় নির্মাণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ রকম আরও অনেক ক্ষতিকর প্রকল্প করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাওর রক্ষা করতে হলে সড়কের বিভিন্ন স্থান কেটে বা বিকল্প ব্যবস্থায় পানিপ্রবাহ সচল রাখতে হবে। অর্থাৎ মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে যেই সড়ক নির্মাণ করা হলো, তার দায় শোধ করতে নতুন করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা ব্যয় করতে হবে।
বাংলাদেশে যে কটি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় জায়গা আছে, তার মধ্যে হাওর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই হাওরকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ ও ধান চাষের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করার বিকল্প নেই। হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামতের ভিত্তিতেই উন্নয়ন প্রকল্প নিতে হবে। হাওরকে নিজের মতো করেই বাঁচতে দিতে হবে।