জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়ার বিষয়টি এমন কঠিন কাজ নয় যে সে জন্য সেবাপ্রার্থীদের মাসের পর মাস ঘুরতে হবে। শহর এলাকায় কাজটি করে থাকে কাউন্সিলর কার্যালয় এবং গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় যে এই নিবন্ধন পেতে নাগরিকদের অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হতে হয়। শহর ও গ্রামনির্বিশেষে সবখানেই একই অবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে উৎকোচ না দিলে জন্মনিবন্ধন সনদ পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ আছে।
কিছুদিন আগে জন্মনিবন্ধন নিয়ে ঢাকায় এক আলোচনা সভায় একজন মেয়র নিবন্ধন সনদ নিয়ে জনগণের রোষানলে আছেন বলেও খেদ প্রকাশ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ করা হয়েছিল, সেটি হলো জন্মনিবন্ধন দেওয়ার জন্য যেসব কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়, সেসব কম্পিউটারের সার্ভার প্রায় ডাউন থাকে। ফলে সেবাপ্রার্থীরা সেবা না পেয়েই ফিরে যান। ওই সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সার্ভার উন্নত করার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের ওয়াদা করেছিলেন। সেই ওয়াদা কতটা পূরণ হয়েছে জানি না, চট্টগ্রামে জন্মনিবন্ধন সনদ জালিয়াতির যে খবর পাওয়া গেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির মৌসুম হওয়ায় জন্মনিবন্ধন সনদ পাওয়ার জন্য অভিভাবকদের ভিড়ও বেশি হয়েছে কাউন্সিলর অফিসগুলোতে। এই সুযোগে জালিয়াত চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে, এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করেছে তারা। এসব সনদ তারা পাসওয়ার্ড হ্যাক করে তৈরি করেছে, না অন্য কোনো কায়দায় সেটি নিশ্চিত নয়।
২১ জানুয়ারি প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, চন্দ্রগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন আইডি হ্যাক করে ৮৪টি সনদ বের করে নিয়েছেন হ্যাকাররা। প্রায় তিন ঘণ্টা হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে থাকার পর আইডির নিয়ন্ত্রণ নেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের কর্মীরা। উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের (৪০ নম্বর) জন্মনিবন্ধন সহকারী বিপ্লব কুমার দেব প্রথম আলোকে বলেন, সকাল ১০টা থেকে স্বাভাবিকভাবেই কাজ
চলছিল। দুপুরে কাজ করতে গিয়ে দেখেন তাঁদের আইডি থেকে অস্বাভাবিক রকমের জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়েছে। এ সময় সার্ভারে অপরিশোধিত অর্থের পরিমাণও বেশি দেখানো হচ্ছিল। কারণ, তাঁরা ওই পরিমাণ টাকার কাজও করেননি। বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হলে দ্রুত পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করা হয়। এর কয়েক দিন পরই চক্রটি নগরের লালখান বাজার ওয়ার্ডের আইডি ব্যবহার করে ১৩৩টি জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এর আগে নগরের পাঁচটি ওয়ার্ড—উত্তর পতেঙ্গা, আন্দরকিল্লা, উত্তর পাহাড়তলী, দক্ষিণ কাট্টলী ও দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহরের আইডি ব্যবহার করে সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে ৫৪৭টি জন্মনিবন্ধন সনদ নেওয়া হয়।
জন্মনিবন্ধন সনদ জালিয়াত চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগ। এ সময় তাঁদের কাছে জালিয়াতির কাজে ব্যবহৃত চারটি সিপিইউ, তিনটি মনিটর, একটি স্ক্যানার ও প্রিন্টার, একটি প্রিন্টার এবং চারটি মোবাইল জব্দ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জন্মনিবন্ধন সহকারীরা ধারণা করছেন, তাঁদের আইডি হ্যাক করে এসব জন্মনিবন্ধন সনদ বের করে নেওয়া হয়েছে।
জন্মনিবন্ধন সনদ জালিয়াতির ঘটনা কেবল চট্টগ্রামে ঘটেছে বলা যাবে না। এর আগে রোহিঙ্গা শরণাপন্ন শিবিরেও অনেকে জালিয়াতদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মসনদ নিয়েছেন। এ অবস্থায় জন্মনিবন্ধন সনদ যঁারা দিয়ে থাকেন, তঁাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে; যাতে তঁাদের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে কেউ সার্ভার হ্যাক করতে না পারে। জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কেউ এই জালিয়াত চক্রকে সহায়তা করেছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।