নির্বাচন প্রশ্নে দলগুলোকে একমত হতে হবে

সম্পাদকীয়

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিজয় দিবসে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে জনমনে যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা অনেকটা কেটে যাবে আশা করা যায়।

তবে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ বা ‘রোডম্যাপ’ না থাকায় প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে তারা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের ধারণা পেলাম, রোডম্যাপ পাইনি।’ জামায়াতে ইসলামী, বিএনপির মিত্র ১২ দল, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারাও অনুরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। আবার কোনো কোনো দল পুরোপুরি সংস্কারের পরই নির্বাচনে পক্ষে।

রাজনৈতিক দলগুলোর এই মিশ্র প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও বলতে হবে, দেশ এখন নির্বাচনী ট্রেনে উঠেছে, কবে সেটি চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছাবে, তা এখন নির্ভর করছে সরকার ও রাজনৈতিক দলের ওপর। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে দুটি বিকল্পের কথা বলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ‘অল্প কিছু সংস্কার চায়’, তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। আর যদি আরেকটু বিস্তৃত সংস্কার, বিশেষ করে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে কিছু করতে হয়, তা হলে আরও ছয় মাস সময় লাগতে পারে।

আমরা মনে করি, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি ভবিষ্যতে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার পথটাও বন্ধ করা জরুরি। এটাই জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু কাজটি শুধু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একক ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। নির্বাচন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার—এটা কখন ও কোন পর্যায়ে হবে; এ ব্যাপারে ছাত্র-নেতৃত্বসহ জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের সব রাজনৈতিক শক্তির ঐকমত্য জরুরি।

নির্বাচনের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক খবরটি হলো উচ্চ আদালত বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির বিধান বাতিল করেছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এই সংশোধনীবলে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কবর রচনা করেছিল। দেশের জনগণের ভোটাধিকার হারানো এবং স্বৈরাচার চেপে বসার মূলে কাজ করেছে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল। আদালতের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্তির বিধান বাতিল হওয়ায় ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কেউ তা বাতিল করতে পারবে না বলে আশা করা যায়।

নির্বাচন কমিশন প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচন করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। তবে নির্বাচনের সময়ের ক্ষেত্রে আবহাওয়া ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাও মাথায় রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশে মে-জুন মাসে আবহাওয়া বৈরী থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা চলে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদ নির্বাচনী প্রচার ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালনের ক্ষেত্রে বড় বাধা। নির্বাচনের সময়সূচি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা। প্রধান উপদেষ্টা তঁার ভাষণে এই সুপারিশগুলো ধরে কীভাবে এগোনো যায়, তারও একটি রূপরেখা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই লক্ষ্যে তাঁর নেতৃত্বে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠন করা হবে। এই কমিশনের কাজ হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে দ্রুত ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া এবং এ ব্যাপারে পরামর্শ চূড়ান্ত করা।

আমরা আশা করব, একটি টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মত্যাগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে ঐকমত্যে আসতে পারবে।