রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য সোমবার দিবাগত রাতটা চরম আতঙ্ক ও শঙ্কার মধ্যে কেটেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় একের পর বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড, হতাহত ও সম্পদহানির ঘটনার মধ্যেই নগরীর একটা বড় অংশজুড়ে প্রবল গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে নগরবাসীর মধ্যে এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
মসজিদের মাইকে সতর্ক করার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্যাসের চুলা, দেশলাই না জ্বালানোসহ সতর্কতামূলক পোস্ট দেন অনেকে। আতঙ্কিত নগরবাসী জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফায়ার সার্ভিসে কল করে তাঁদের এলাকায় বাতাসে গ্যাসের গন্ধ পাওয়ার খবর জানান। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে গ্যাসের গন্ধ ছড়ানোর ব্যাখ্যা দেয় এবং নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু তাদের এই ব্যাখ্যা ও পরামর্শে আশ্বস্ত হওয়ার আদৌ কি কোনো কারণ আছে?
২০২১ সালে মগবাজারে তিতাসের একটি পরিত্যক্ত গ্যাসলাইনের ছিদ্র থেকে জমা হওয়া গ্যাসে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ভবন বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। গত ৪ মার্চ রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে একটি ভবনে বিস্ফোরণের সম্ভাব্য একটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে, ভবনটিতে জমে থাকা গ্যাস। এরপর ২৬ মার্চ সিদ্দিকবাজারে ভবনে বিস্ফোরণের বহু হতাহতের যে ঘটনা ঘটে, প্রাথমিক তদন্তে সেই বিস্ফোরণের সম্ভাব্য কারণ হিসেবেও তিতাসের পরিত্যক্ত লাইনে লিকেজের বিষয়টি উঠে আসে।
সোমবার রাতেই গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ঈদে শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় (ওভার ফ্লো) গন্ধ বাইরে আসছে।’ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীও ফেসবুক পোস্টে নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ঢাকার গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কয়েক ঘণ্টা পর মঙ্গলবার সকালে তিতাস গ্যাসের উপব্যবস্থাপক জানান, সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটার সমাধান হয়েছে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, রাজধানীর মগবাজার, ইস্কাটন, রামপুরা, মহাখালী, পূর্ব রাজাবাজার, ক্রিসেন্ট রোড, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বাড্ডা ও হাজারীবাগের বাসিন্দারা তাঁদের এলাকায় গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার কথা জানান। ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় মন্ত্রণালয় ও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতে আমরা কোনোভাবেই আশ্বস্ত হতে পারি না। জ্বালানিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসঙ্গে এতগুলো জায়গায় গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার অর্থ হচ্ছে, তিতাসের গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। এটি অবশ্যই একটি বিপজ্জনক ইঙ্গিত।
জ্বালানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার এ ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিতে পারত, সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়, তিতাসের পাইপলাইনে অনেক ছিদ্র আছে, কিন্তু সেটা থাকার কথা নয়। হয়তো স্বাভাবিক সময়ে চাপ কম থাকায় এটা টের পাওয়া যায় না। এখন চাপ বেশি হওয়ায় বিষয়টা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এতে অনেক স্থানে গ্যাস জমে থাকার একটা ঝুঁকি তৈরি হয়, যেটা পরবর্তী সময়ে বিস্ফোরণ বা দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠতে পারে।’
সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে লিকেজের ফলে জমে থাকা গ্যাস শক্তিশালী বোমার মতো। একটি স্ফুলিঙ্গই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিতে পারে। নগরবাসীকে এ রকম জলজ্যান্ত বোমার ওপর রেখে মন্ত্রণালয় ও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ কীভাবে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেয়, আমাদের কাছে তা বোধগম্য নয়।
গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার মতো বিপজ্জনক ঘটনাকে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ যেভাবে খাটো করে দেখছে, সেভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ছিদ্রগুলো শনাক্ত করে যত দ্রুত সম্ভব পাইপলাইনগুলো প্রতিস্থাপন করতে হবে।
ঢাকায় গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার এ ঘটনা সবার জন্য সতর্কবার্তা। এ থেকে শিক্ষা নিতে না পারলে ভয়াবহ যেকোনো পরিণতির জন্যই নগরবাসীকে প্রস্তুত থাকতে হবে।