আইনি প্রতিকার ও সামাজিক শুশ্রূষা জরুরি

সম্পাদকীয়

মুঠোফোনপ্রযুক্তির ব্যবহার অনেক গুণ বেড়েছে। এখন মানুষ যোগাযোগ, কেনাকাটাসহ অনেক কাজেই এ মাধ্যমের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কিন্তু এই মুঠোফোনপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে অনলাইনে হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাও বেড়েছে, যা ব্যবহারকারীদের জন্য উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি টেলিযোগাযোগের প্রতিষ্ঠান টেলিনর প্রকাশিত ‘টেলিনর এশিয়া ডিজিটাল লাইভস ডিকোডেড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অর্ধেক মাসে অন্তত একবার হলেও হয়রানি বা উৎপীড়নের শিকার হন।

চলতি বছরের আগস্টে টেলিনর এশিয়া বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আটটি দেশে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্য থেকে ৮ হাজার ৮৭ জনের ওপর জরিপটি চালায়। বাকি সাতটি দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। ১৮ বছর ও এর বেশি বয়সী ব্যক্তিরা জরিপে অংশ নেন। এতে বাংলাদেশের ১ হাজার ১১ জন ছিলেন।

জরিপে অংশ নেওয়া ৮ হাজারের বেশি ব্যবহারকারীর মধ্যে ১৭ শতাংশ বলেছেন, গত দু–এক বছরে তাঁরা প্রতি মাসে অন্তত একবার হলেও অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন। আটটি দেশের মধ্যে মাসে অন্তত একবার অনলাইনে হয়রানির শিকার হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এটি ৫০ শতাংশ।

জরিপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে ৮ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা দিনে একবার হলেও অনলাইনে হয়রানির শিকার হন। অন্যদিকে অনলাইনে দিনে একবার হয়রানির শিকার হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে (১১ শতাংশ)। বাংলাদেশে ৮ শতাংশ। উল্লেখ্য, অনলাইনে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন তরুণেরা। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের প্রায় ৭০ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা গত দু–এক বছরের মধ্যে অনলাইনে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন; যাঁদের ৭৯ শতাংশ বলেছেন, এই হয়রানি তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

মুঠোফোনপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে যে নিয়ত মানুষ হয়রানি ও পীড়নের শিকার হচ্ছেন, তার সব খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না। কিছু কিছু আসে। হয়রানির শিকার অনেক মেয়ে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেনস্তার কারণে আত্মহত্যা করেছে। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে—এ রকম ভুক্তভোগীর সংখ্যাও কম নয়।

এসব দুর্ঘটনা ও হয়রানি থেকে রেহাই পেতে প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের যেমন সজাগ থাকতে হবে, তেমনি এর প্রতিকারে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারকেও এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেছেন, সাইবার বুলিং রোধে পরিবারের ভূমিকাই বড়। ছবি বা ভিডিও আপলোড করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। ছেলেমেয়েদের বিপরীত জেন্ডারের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করতে শেখানোর ওপরও জোর দেন এই শিক্ষাবিদ।

তবে সব দায়িত্ব মা–বাবার ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। এ বিষয়ে আইনি সুরক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা জরুরি। মুঠোফোন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের নিয়মিত দিকনির্দেশনা দিলে এর বিপদ সম্পর্কে গ্রাহকেরা জানতে পারবেন।

মুঠোফোনপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে কেউ হয়রানির শিকার হলে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার প্রতি শুশ্রূষার হাত বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভুক্তভোগী কোনো অপরাধ করেননি, অপরাধের শিকার হয়েছেন। তাকে কোনোভাবে অপদস্থ বা গালমন্দ করা যাবে না।

একই সঙ্গে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টি জানাতে হবে। অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে আইনের আশ্রয় নিতে চান না। এতে অপরাধীরাই আশকারা পেয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তদন্তের সময় নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনোভাবে ভুক্তভোগীদের নাম–ঠিকানা প্রকাশ না পায়।