বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এযাবৎকাল যত দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে ও প্রমাণিত হয়েছে, তাতে সর্বজনগ্রাহ্য যৌক্তিক সাধারণ ধারণা হলো, এই প্রতিষ্ঠানের যেখানে হাত দেওয়া হয়, সেখানেই দুর্নীতি-অনিয়মের গন্ধ পাওয়া যায়।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত আরও একটি দুর্নীতির খবর উপরিউক্ত ভাষ্যকে যথার্থ যৌক্তিকতায় অধিকতর জোরালো করেছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে টিকিট কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন সেবা ক্রয়ে ‘জালিয়াতিপূর্ণ’ চুক্তির কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। ১০ বছরে এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা।
সরকারের বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, চুক্তির আগে আর্থিক প্রস্তাবে কিছু সেবার বিপরীতে খরচ যা হবে, তার চেয়ে কম দেখানো এবং কিছু সেবা বাবদ খরচ গোপন করা হয়েছে। আবার কিছু সেবা বাবদ ব্যয় আর্থিক প্রস্তাবে না দেখিয়ে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কারসাজির সঙ্গে বিমানের বর্তমান একজন পরিচালকসহ কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ আছে।
দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সেবার গ্লোবাল ইনকরপোরেশনের সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদি চুক্তিটি করে বিমান। চুক্তি অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টিকিট বুকিং ও বিক্রিসংক্রান্ত এজেন্টদের ব্যবহৃত প্রযুক্তি গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস), এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রিসংক্রান্ত প্যাসেঞ্জার সার্ভিস সিস্টেম (পিএসএস), বিমানবন্দরে চেক-ইন ও বোর্ডিং কার্ডসহ অন্যান্য সেবা ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত ডিপারচার কন্ট্রোল সিস্টেম (ডিসিএস), ই-কমার্স, লয়্যালটি সার্ভিসের মতো সেবাগুলো পাবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই চুক্তির আগে বিমানের পরিচালনা পর্ষদে দেখানো হয়েছিল যে এসব সেবা ক্রয়ের জন্য ১০ বছরে ওই প্রতিষ্ঠানকে ২৮২ কোটি টাকা দিতে হবে। পরিচালনা পর্ষদও সে অনুযায়ী চুক্তির অনুমোদন দেয়। সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া নিরীক্ষায় দেখা গেছে, চুক্তিটি এমনভাবে করা হয়েছে, যার ফলে এসব সেবার জন্য বিমানকে ১০ বছরে মোট ১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা দিতে হবে, যা পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা বেশি।
প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রেও আইন মানা হয়নি। আইনে আছে দরপত্রের সংক্ষিপ্ত তালিকায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চারটির কম হলে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করতে হবে। এখানে সংক্ষিপ্ত তালিকায় তিনটি প্রতিষ্ঠান িছল এবং কর্তৃপক্ষ এমনভাবে শর্ত জুড়ে দেয়, যাতে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানটিকেই বেছে নেওয়া হয়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় যে ইচ্ছেমতো পরিচালনা করা যাবে। কোনো সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করার আগে অনেকগুলো ধাপ তাকে পার হতে হয়। একাধিক কমিটি আছে এবং এসব কমিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে সেটা হয়নি বলেই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি গুনতে হচ্ছে। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পরও এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি গঠন না হওয়াও দুর্ভাগ্যজনক।
তাহলে কি বিমানের পদাধিকারীদের মধ্যে এমন কেউ আছেন, যাঁরা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, বিমানে ‘সাগরচুরি’ হচ্ছে। বিমান কেনা থেকে শুরু করে টিকিট বিক্রি—সবখানে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে টিকিট কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন সেবা ক্রয়ে ‘জালিয়াতিপূর্ণ’ চুক্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হোক। জাতীয় পতাকাবাহী বিমানকে জঞ্জালমুক্ত করা হোক।