আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকা হতাশাজনক

সম্পাদকীয়

চলমান বৈশ্বিক সংকটের ধাক্কায় বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি ও জনজীবন। কয়েক মাস আগে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ভুক্তভোগী হয়েছে মানুষ। এবার ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ধাক্কায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলো দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, মধ্য অঞ্চল ও দক্ষিণ উপকূলের মানুষ।

এ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রাণহানি ঘটেছে ৩৫ জনের। ঘরবাড়ি, মাছের ঘের, পুকুর ও কৃষকের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখন ধান ও শীতকালীন আগাম সবজি নিয়ে শঙ্কায় আছেন চাষিরা। এর আগে আমন মৌসুমের শুরুতে খরার কারণেও ভুগতে হয়েছে তাঁদের।

অতীতের তুলনায় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে এনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বেশ অগ্রগতি হয়েছে আমাদের। এবারের ঘূর্ণিঝড়েও খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তেমন নয়। তবে যা ক্ষতি হয়েছে, সেটিও কোনোভাবে অগ্রাহ্য করা যাবে না। বিশেষ করে এতগুলো প্রাণহানির কথা বলতেই হয়।

ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো না গেলেও এক থেকে দুই সপ্তাহ আগ থেকে যথাসময়ে ও সুনির্দিষ্ট আবহাওয়া পূর্বাভাসের মাধ্যমে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বিশ্বজুড়ে এভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, সিত্রাংয়ের পূর্বাভাস দেওয়া নিয়ে আমাদের আবহাওয়া অধিদপ্তরকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সোমবার সকাল থেকে, এমনকি সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার বুলেটিনেও জানিয়েছিল, ঘূর্ণিঝড়টি সেদিন দিবাগত মধ্যরাত বা পরদিন মঙ্গলবার ভোর নাগাদ ভোলার কাছ দিয়ে অতিক্রম শুরু করতে পারে। অথচ সেদিন সন্ধ্যা ছয়টায়ই ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করে। আর সেদিন পরবর্তী বুলেটিনে রাত দশটায় বলা হয়, রাত নয়টায় ঘূর্ণিঝড়টি ভোলার কাছ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে নানা আলোচনা-সমালোচনা আমরা দেখতে পাই।

শুধু তাই নয়, উপকূলের কোন অঞ্চল দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি ঢুকবে, সেটি নিয়েও বিভ্রান্তি ছিল আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো বলছিল, সোমবার দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করতে পারে সিত্রাং। প্রথম আলো আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসের পাশাপাশি স্বাধীন আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকারও প্রকাশ করে, যেখানে আন্তর্জাতিক পূর্বাভাস মডেলগুলোর পূর্বাভাসই প্রতিফলিত হয়। একইভাবে ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথও।

ঘূর্ণিঝড় নিয়ে এমন বিভ্রান্তির কারণ হিসেবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের যুক্তি হচ্ছে, সিত্রাং বেশ অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। বারবার গতিপথ বদলানোর কারণে এটি কোথায় আঘাত করবে, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না তাদের পক্ষে।

আর রাত নয়টায় ভোলায় আঘাত হানার পর আবহাওয়া অধিদপ্তর বুঝতে পারলেও বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ ব্যাহত হওয়ায় তা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে তুলতে দেরি হয়ে যায়।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়া পূর্বাভাসের ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানের মডেল ও কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ ছাড়া এসব তথ্য বিশ্লেষণে তাদের সক্ষমতা আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য এবং দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, আবহাওয়াবিদ্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়ার আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে জনবল কম আছে।

এ ক্ষেত্রে তাঁদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে এমন ভুল থেকে আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে।’ আমরাও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছি, আবহাওয়া অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ জরুরি।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড় এ দেশে আঘাত হানছে। তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও এর ধাক্কা দীর্ঘদিন ধরে থেকে যায় জনজীবনে। এসব ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাড়ছে দেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা। ফলে দুর্যোগ মোকাবিলায় আবহাওয়া অধিদপ্তরকে আরও বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকায় দেখতে চাই আমরা।