যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরটি এমন ছিল না যে তিনি এলেন, কথা বললেন, আর সব সমস্যার সুরাহা হয়ে গেল।
উজরা জেয়া ও তাঁর সফরসঙ্গীরা বাংলাদেশে অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও সরকারের একাধিক মন্ত্রী-উপদেষ্টার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে।
এসব বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানবাধিকার, আইনের শাসন, শ্রমিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। আলোচনা হয়েছে ইতিপূর্বে সাত র্যাব কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও নতুন মার্কিন ভিসা নীতি নিয়েও।
বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উজরা জেয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা পরিহার করে সত্যিকারের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও ন্যায্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে সব পক্ষকে আহ্বান জানাই।’
মার্কিন প্রতিনিধিদল যখন বাংলাদেশে অবস্থান করছিল, তখন ঢাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি ঢাকায় দুটি বড় সমাবেশ করে। দেড় কিলোমিটারের মধ্যে একই সময়ে দুটি সমাবেশ হলেও সংঘাতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। দেশবাসীর মতো মার্কিন প্রতিনিধিদলও দুই দলের এই সহিষ্ণু আচরণকে স্বাগত জানিয়েছে। এতে প্রমাণিত হলো, রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করতে পারে। যদিও নিকট অতীতে বিরোধী দলের কর্মসূচি নিয়ে হামলা-সংঘর্ষের বহু ঘটনা ঘটেছে।
মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফর নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করেছে। সরকারি দল একভাবে সফরকে ব্যাখ্যা করছে, বিরোধী দল আরেকভাবে। এখানে পক্ষ-বিপক্ষের বিষয় নয়। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি যেসব মন্তব্য করেছেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হবে। তিনি যে বলেছেন, ‘আসুন, আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিই’, এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন সম্পর্কে বেশ পরিষ্কার বার্তাই দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি সমস্যা সমাধানে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও এর অংশীদার না হওয়ার কথা বলেছেন। বরং তারা চায় রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করুক।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—উভয় সমাবেশ থেকে ‘এক দফা’ ঘোষণা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। বিএনপির দাবি, নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।
আপাতদৃষ্টে দুই দলের দুই দফা বিপরীতমুখী মনে হলেও এর মধ্যেও একটি সমঝোতার ইঙ্গিত আছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘এক দফা’ ঘোষণা করেও তারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপরই জোর দিয়েছে। তাদের লক্ষ্য যদি অভিন্ন হয়, তাহলে কেন সুষ্ঠু নির্বাচনের বাধাগুলো দূর করা যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলেছে এবার তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চাওয়াও তাই।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই পক্ষের দায় থাকলেও এই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করণীয়, সে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার মূল দায়িত্ব সরকারি দলকেই নিতে হবে।
অতীতে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান না হওয়ার জন্য যখন আওয়ামী লীগ বিএনপির একগুঁয়েমি মনোভাবকে দায়ী করে, তখন তাদের একই অবস্থানে থেকে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়াও নিশ্চয়ই রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় নয়। অতীতের ভুল থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব শিক্ষা নেবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।