সম্পদ কর আদায় বাড়াতে হবে

সম্পাদকীয়

‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ শিরোনামের যে আন্দোলনে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্ক শহর কেঁপে উঠেছিল, তার উদ্ভব হয়েছিল বৈষম্য থেকে। ওই আন্দোলনের মূল স্লোগান ছিল ‘৯৯ ভাগে আমরাই’।

তঁাদের বক্তব্য ছিল, ধনীদের করছাড় দিয়ে বৈষম্য বাড়ানো হচ্ছে আর সেই বোঝা চাপছে গরিব এবং মধ্যবিত্তের ঘাড়ে। অথচ সবাই জানে, ১ শতাংশ অতিধনীর সঙ্গে, বাকি ৯৯ শতাংশ লোকের আয় এবং সম্পত্তির ব্যবধান কমিয়ে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা না গেলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও গণতান্ত্রিক কাঠামোটিই ভেঙে পড়বে। তাতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তা শুধু সেই ১ শতাংশের জন্যই ‘সুদিন’ আনবে।

খেয়াল করা দরকার, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটি হচ্ছিল এমন এক দেশে, যেখানে সম্পদের সুষম বণ্টনের বিষয়ে জোর নজরদারি আছে, যেখানে আইন মেনে আইন বাস্তবায়িত হয়। সেখানে নিজ অধিকার নিয়ে নাগরিকেরা সচেতন। তাই আর্থিক বৈষম্য তাদের কাছে গুরুতর বিষয়।

অন্যদিকে আমাদের দেশে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সম্মিলিত জনতার আন্দোলন কোনোকালে হয়নি। এটি যে একটি আন্দোলনের বিষয় হতে পারে, সে ধারণাও এ দেশের সামগ্রিক জনমানস এত দিনে আত্মস্থ করে উঠতে পারেনি। ফলে যা হওয়ার কথা, তা-ই হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে দেশের সাম্প্রতিক যে বৈষম্য চিত্র পাওয়া গেছে, তা ‘অর্থনীতির অক্ষরজ্ঞান’ থাকা যে কারও জন্য অস্বস্তিকর।

ওই সংলাপে অংশ নেওয়া বক্তাদের বক্তব্য থেকে জানা যাচ্ছে, দেশে মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়বৈষম্যও বেড়েছে। আর আয়বৈষম্যের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে সম্পদের বৈষম্য। অর্থাৎ হাতে গোনা লোকের হাতে পাহাড়সমান সম্পদ জমেছে, এর বিপরীতে বৃহৎ অংশের মানুষের কাছে যে সম্পদ আছে, তা খুবই সীমিত। সম্পদের এই বৈষম্যের প্রধান কারণ কার্যকরভাবে সম্পদ কর আদায় করা হচ্ছে না। ঠিকমতো এই কর আদায় করা গেলে সম্পদের বৈষম্য দূর করা সম্ভব।

রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সম্পদ কর গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে সারা বিশ্বের সর্বত্র স্বীকার্য। অথচ বাংলাদেশে বার্ষিক রাজস্ব আয়ের মাত্র দশমিক ৫ শতাংশের কম আসে সম্পদ কর থেকে। অর্থাৎ যে রাজস্ব আয় দিয়ে একটি দেশ চলে, তাতে সম্পদ করের বলা চলে কোনো ভূমিকাই নেই।

তার মানে ধনীদের অধিকারে থাকা সম্পদের ওপর কর প্রযুক্ত হচ্ছে না। কিন্তু দেশ চালাতে যেহেতু রাজস্ব দরকার, সেহেতু সেই রাজস্ব তোলা হচ্ছে প্রধানত সাধারণ মানুষের পণ্য কেনার ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের মধ্য দিয়ে। এতে বৈষম্য উত্তরোত্তর বাড়ছে।

যে দেশে যত মাথাপিছু আয় বাড়ে, সেখানে তত সম্পদ কর আদায় বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে তা হচ্ছে না। এ কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে বছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার বাড়তি সম্পদ কর আসছে না।

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিষয়টি বিবেচনা করে সম্পদ কর আহরণ বাধ্যতামূলক ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। সিপিডির সংলাপে উত্তরাধিকার সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কর আরোপের প্রস্তাব এসেছে। এসব প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।

তবে এসব কর আদায় ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হওয়া দরকার। একই সঙ্গে এমন উচ্চ হারে এই কর নির্ধারণ করা ঠিক হবে না, যা অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।