গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুতের লোডশেডিংও বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় জনজীবন অতিষ্ঠ। কোথাও কোথাও বিক্ষোভ-ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।
রোববার রাতে বিক্ষুব্ধ গ্রাহকেরা মিছিল নিয়ে ছাগলনাইয়া পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ে হামলা করেন। তাঁরা কার্যালয়ের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে বিভিন্ন কক্ষে আসবাব ভাঙচুর ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নষ্ট করেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, আগামী মে মাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ধরে ১৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। দাবদাহের কারণে এপ্রিলেই চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে গরম থাকছে বেশি। এ সময় গড়ে কমবেশি উৎপাদিত হচ্ছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এতে কখনো কখনো ঘাটতি থাকছে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
গরমের শুরুতে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে লোডশেডিং ঠেকানো যাবে বলে আশা করেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। ৬ এপ্রিল থেকে দিনে ৭৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে ভারতের আদানি গ্রুপ। দেশের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা থেকে পাওয়া যাচ্ছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বেশি।
তবে নিজস্ব কয়লায় চালিত বড়পুকুরিয়ায় একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে আছে। গত শনিবার থেকে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনও বন্ধ রয়েছে। জানা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। গত ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরুর পর ইতিমধ্যে কেন্দ্রটি কয়েক দফায় বন্ধ হয়েছে। কারিগরি কারণে আশুগঞ্জ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিট বন্ধ হয়ে আছে।
বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সাফল্য নানা কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিতে সচেষ্ট ছিল। জ্বালানির উৎসের বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনায় না নিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়িয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। গত তিন মাসে তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়তে পারে বলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন।
বিদ্যুৎ আসে দেশে উৎপাদিত গ্যাস ও কয়লা এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা তেল, গ্যাস ও কয়লা থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া ও ডলার-সংকটের কারণে স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ রাখে বাংলাদেশ। বর্তমানে দাম কমলেও ডলার-সংকটের কারণে চাহিদামাফিক জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না।
জ্বালানিবিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, বিদ্যুৎ খাতের এই বিপর্যয়ের জন্য সরকারের পরনির্ভরশীল জ্বালানিনীতি দায়ী। দেশের স্থল ও সমুদ্র উপকূলে নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণের চেষ্টা নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল, সরকার তা আমদানি করে মুনাফা করেছে।
এখন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে। গত বছর সংকট কাটাতে রেশনিং পদ্ধতি চালু করেছিল। এবারে পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। পরিবেশবিদদের আপত্তি উপেক্ষা করে রামপালে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, তা দফায় দফায় বন্ধ থাকায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সব মিলিয়েই বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের শিগগিরই কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সরকার একটু সচেষ্ট হলে চুরি-অপচয় নিশ্চয়ই কমাতে পারে। সরবরাহ লাইনকে ত্রুটিমুক্ত রাখতে পারে। শতভাগ ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হওয়ার চেয়ে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং কমানোর চেষ্টা করতে হবে।