বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা, সুষম পুষ্টি, বেকার সমস্যার সমাধান এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রাণিসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এ ক্ষেত্রে কৃষককে সহায়তায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের যেসব কর্মসূচি ও প্রকল্প আছে, সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, অসুস্থ গরু-ছাগলকে জরুরি চিকিৎসা দিতে গত বছরের শুরুর দিকে ১৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৬০টি গাড়ি কেনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। কিন্তু এসব গাড়ি অসুস্থ প্রাণীর চিকিৎসার জন্য ব্যবহার না করে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কাজে লাগানো হচ্ছে।
গাড়ি নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কেউ যাচ্ছেন মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে, কেউ বাসা-অফিস যাতায়াতে, কেউবা ভ্রমণের কাজে ব্যবহার করছেন।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, অসুস্থ প্রাণীর চিকিৎসায় বড় আকারের গাড়ি দেওয়া হয়েছে, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষকের গরু-ছাগল অসুস্থ হলেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কৃষকেরা বলেছেন, বাড়িতে গাড়ি নিয়ে এসে প্রাণীর চিকিৎসা দেওয়া হয়, এমন খবরই তাঁদের জানা নেই।
এ ছাড়া এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে আলট্রাসাউন্ড মেশিন (গরুর গর্ভধারণ পরীক্ষার যন্ত্র) ও ক্রিম সেপারেটর (দুধ থেকে ছানা আলাদা করার যন্ত্র) পাঠানো হয়। কিন্তু কীভাবে এসব যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়, সে প্রশিক্ষণ কাউকে দেওয়া হয়নি। তাই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে যন্ত্রগুলো। প্রকল্পের আওতায় গরু-ছাগলের টিকা (ভ্যাকসিন) সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি উপজেলায় ডিপ ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটরসহ যেসব যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে, তারও বেশির ভাগ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।
গত ২৭ জুলাই ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদক দেখতে পান, রেফ্রিজারেটরের প্যাকেট খোলা হয়নি। ডিপ ফ্রিজও খালি। আলট্রাসাউন্ড মেশিনও ব্যবহৃত হচ্ছে না। ক্রিম সেপারেটর যন্ত্রও পড়ে আছে। এসব যন্ত্রের কোনোটি এই উপজেলায় এসেছে এক মাস আগে, কোনোটি পৌঁছেছে দুই মাস আগে।
একই উপজেলার প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জান্নাতুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, আলট্রাসাউন্ড কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। গত ২০ জুলাই প্রথম আলোর প্রতিবেদক মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গিয়ে দেখতে পান, প্রকল্পের আওতায় পাঠানো বিভিন্ন যন্ত্র একটি কক্ষে বাক্সবন্দী অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর করোনাকালে খামারিদের নগদ অর্থসহায়তা বাবদ যে ৭৫২ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়েছে, তা নিয়েও আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)। ২০২০ সালে সারা দেশে প্রায় ছয় লাখ ক্ষতিগ্রস্ত খামারিকে ১২ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদ সহায়তা দেওয়া হয় এই প্রকল্প থেকে।
ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের তালিকা করা হয় উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু তালিকায় নাম থেকেও অনেক খামারি নগদ সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ উঠেছে। পিইসি ১ হাজার ২০ জন খামারির সঙ্গে কথা বলেছে, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ খামারি নগদ সহায়তার টাকা পেয়েছেন, বাকিরা পাননি।
এসব থেকে ধারণা করা যায় যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রায় প্রতিটি প্রকল্পেই ব্যাপক অনিয়ম ও অপচয় হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাঁদের ওপর ন্যস্ত, তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতা ও অদক্ষতার কারণেই এটি হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রকল্পগুলো নিয়ে যেসব অনিয়ম–অপচয়ের অভিযোগ উঠেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।