স্থানীয় সরকার সংস্থাকে শক্তিশালী করা হোক

সম্পাদকীয়

আমাদের সংবিধানে স্থানীয় শাসনের কথা বলা হলেও কোনো সরকার স্থানীয় শাসন, তথা স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়নি; বরং কীভাবে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ করে রাখা যায়, সেই চেষ্টাই চালিয়ে গেছে।

ঔপনিবেশিক সরকারের আমল থেকে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন হতো নির্দলীয় ভিত্তিতে। নির্দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ায় অতীতে আওয়ামী লীগ আমলে বড় বড় সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপি বা অন্য দলের সমর্থকেরা নির্বাচিত হয়ে আসতেন। আবার বিএনপির আমলেও আওয়ামী লীগ কিংবা অন্য দলের সমর্থকেরা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের একটা ভারসাম্য ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালে আইন করে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনকে দলীয়ভাবে করার সিদ্ধান্ত নেয়, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক প্রভাব ব্যবহার করে সরকারদলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা। দু-একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরাই জয়ী হয়ে এসেছেন।

এ অবস্থায় বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন বর্জন করে। ফলে জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হন। সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত এই ধারা লক্ষ করা গেছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পর বেশির ভাগ স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আত্মগোপনে চলে যান। এ অবস্থায় সরকার স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করার কারণেই ওই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়র, ৬০টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সারা দেশের সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। স্থানীয় সরকারের এই চার স্তরে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮৭৬ জন জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেও জনগণ তো এলাকায় আছেন এবং সেবা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হতে পারেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করা ছাড়া সরকারের কাছে বিকল্প ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রশাসকেরা কত দিন সেখানে দায়িত্ব পালন করবেন? আওয়ামী লীগ সরকার স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে দলীয়করণ করেছে বলে প্রশাসক নিয়োগ স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। আইনে ছয় মাস পর্যন্ত প্রশাসক দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এরপর নির্বাচন দিতে হবে।

অন্যদিকে সব স্থানীয় সংস্থার নির্বাচিত প্রতিনিধিকে সরানো হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা বহাল আছেন। সিটি করপোরেশনের মেয়রদের সরানো হলেও কাউন্সিলরদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ এই পদক্ষেপকে সমগ্র স্থানীয় সরকারকে পরিচ্ছন্ন করার প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করেছেন।

স্থানীয় সরকার সংস্থাকে অবশ্যই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে ও কাজ করতে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত সময়ে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন হওয়া জরুরি। একই সঙ্গে তাদের আর্থিক সামর্থ্যও বাড়াতে হবে। সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকারের মুঠোয় রাখা ঠিক নয়। দেশবাসী সত্যিকার অর্থে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার দেখতে চায়।